প্রশ্নফাঁস আর দুর্বৃত্তায়ন নিয়েই জাতির মেরুদ-!
‘দিনমজুর বাবা মায়ের কষ্ট দূর করার জন্য প্রায় ৩ বছর ধরে চাকুরির জন্য পথে-ঘাটে লড়ছি, আর সব পরীক্ষার প্রশ্ন তারা আর কাজ করতে ও আমাকে টাকা দিতে পারছেন না, তখন আর কথা বলতে পারি না। মুখ থেকে কথা বের হয় না, টেনশনে ঘুম আসে না, চোখের পানিতে বালিস ভিজে থাকে। ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমাতে হয়। হায়রে স্বাধীন দেশ, কষ্টের মূল্যায়ন নেই।’ কথাগুলো এক যুবক আক্ষেপ করে এ লেখককে বলেছেন। একথা ঠিক যে, কারও স্বপ্নভঙ্গ যদি হতাশায় রূপ নেয় তার জন্য মাথা তুলে দাঁড়ানো বড়ই কঠিন।
সারাজীবন বয়ে বেড়ানো এই অপূর্ণ স্বপ্নের বোঝার সাথে চোখের সামনে স্বপ্ন পুড়ে যাওয়া, স্বপ্ন ভঙ্গের যন্ত্রণা, দীর্ঘশ্বাস, বুকফাঁটা আর্তনাদ, হাহাকার, দেখার মতো কেউ আছে কি? থাকলে কি করে একে পর এক চাকুরির কি ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র আউট হচ্ছে? ভয়ানক ব্যাধি প্রশ্ন ফাঁস বন্ধ হবে কি? না পুরোনো খবরগুলোর নতুন সংস্করণই বারবার দেখব আমরা। আবারো পরীক্ষা আসে প্রশ্ন ফাঁস, তদন্ত কমিটি গঠন, কয়েকদিন এ নিয়ে হইচই তারপর আবার সবাই ভুলে যায়। এরকম আর কতদিন চলবে, তা কেউ বলবেন কি? দেশের ভর্তি পরীক্ষা ও সরকারি নিয়োগ প্রক্রিয়ায় প্রশ্নপত্র ফাঁস নামে যে অধঃপতনের ধারা ও দূষণ প্রতিরোধ বা প্রতিকারের ন্যূনতম ইচ্ছাও সংশ্লিষ্টদের আছে কি?
ক্লাস ওয়ান থেকে পিতা-মাতা ও সন্তানের স্বপ্ন থাকে ডাক্তার হবার। সেই ১২/১৪ বছর বয়ে বেড়ানো স্বপ্নের বেঁচাকেনা করছে এদেশের কতিপয় দুর্বৃত্ত। অপূর্ণ স্বপ্নের বোঝা আজীবন বয়ে বেড়ানোর যন্ত্রণা এসব মানুষ রূপী পশুরা কখনো বুঝবে না। কেননা, তাদের সন্তানদের অন্যদের মতো গা খাটুনির পরিশ্রম করে, ঘুমে ঢুলু ঢুলু চোখ নিয়েও ক্লান্ত দেহটাকে চেয়ারে বসিয়ে অনিমিখ চোখের দৃষ্টি বইয়ের পাতায় নিবদ্ধ করতে হয় না। কেউ ক্ষমতা আর কেউ টাকার জোরে পরীক্ষার আগের রাতেই প্রশ্নপত্র পেয়ে যায়।
এভাবে চলতে থাকলে শিক্ষা নয় দুর্বৃত্তায়ন নিয়েই আমাদের জাতির মেরুদ- গড়ে উঠবে। অন্ধকারের কানাগলির মধ্যে নিপতিত আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম। যে রাষ্ট্রে সবকিছুই চলে অনৈতিকতায় সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিতে, চাকুরিতে অনৈতিকতা না থাকলেতো হবে না! এ দেশ কোথায় যাচ্ছে? উন্নয়নের জোয়ারে ভাসতে ভাসতে গভীর সাগরে নিমজ্জিত হয়ে যাচ্ছে নাকি? সব দিকেই আজ খাই খাই আওয়াজ। তবে সুস্থ থাকতে হলে- রঙে ভরা বঙ্গে ও সব সম্ভবের দেশ বাংলাদেশে অসীম ধৈর্য্য নিয়ে সবকিছু মেনে নেওয়ার অভ্যাস করতে হবে।
নৈতিকতা যদিও কখনো আইন করে শেখানো যায় না। কিন্তু একথা ঠিক যে, অনৈতিক কাজে লিপ্ত ব্যক্তিদের কঠোর আইন প্রয়োগ করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করা যায়! আড়াল, অস্বীকার, কিংবা এড়িয়ে অপরাধ দূর করা যায় না। সমস্যার ধরন বুঝেই সমাধানের পন্থা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে হবে। গুটিকয়েক অসৎ লোকের কাছে কী করে রাষ্ট্র আমাদের সন্তানের ভবিষ্যৎ তুলে দিচ্ছে। কত বড় বড় সমস্যা সরকার সমাধান করছে। তবে কেন প্রশ্নপত্র ফাঁসের সমাধান করছে না? এটা আমরা বুঝতে পারছি না।
এর সাথে প্রশ্নপত্র ফাঁস এবং তাকে অস্বীকারের ঘটনা এ দেশে একটি নৈমিত্তিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধ করতে হলে আগে তো কর্তৃপক্ষকে স্বীকার করতে হবে। তারপর না পরবর্তী পদক্ষেপ। আফসোসের বিষয় আজ পর্যন্ত কেউ এটা স্বীকারই করেনি। অর্থাৎ সংশ্লিষ্টদের ভাবখানা এমন যে- প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে তাতে কি! উত্তর তো ফাঁস হয় নি। তার মানে পরীক্ষা সুষ্ঠু হয়েছে। এটাই হয়তো সংশ্লিষ্টদের মনের কথা!
যদিও কিছুদিন আগে শিক্ষামন্ত্রী সংসদে বলেছেন, পরীক্ষার প্রশ্নফাঁস এই সরকারের জন্য জীবন-মরণ সমস্যা! যদি সত্যি এটা এই ‘জীবন-মরণ’ সমস্যা হয়ে থাকে তাহলে কেন এর সমাধানে কোনো চেষ্টা নেই? জীবন-মরণ সমস্যা সমাধানের জন্যে কি জীবন-মরণ চেষ্টা করতে হয় না? আমরা কি সেটা দেখছি?
আমাদের পুরো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থায় প্রশ্ন ফাঁস, খাতা জালিয়াতি, ছাত্রীদের সাথে অনৈতিক সম্পর্কের ফাঁদ পেতে পাস করিয়ে দেওয়ার সাথে নকল করার যে প্রতিযোগিতা চলছে, তা বন্ধের উদ্যোগ নেবে কে? শিক্ষাক্ষেত্রে দুর্বৃত্তায়ন প্রতিরোধ এবং প্রতিকারে সরকারকেই সোচ্চার ও অগ্রণী ভূমিকা নিতে হবে।
ভর্তির সময়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, শিক্ষক, ছাত্র ছাড়াও রাজনৈতিক ছাত্রসংগঠনের ছত্রচ্ছায়ায় প্রতিষ্ঠিত নামিদামি কোচিং সেন্টারগুলোর বাড়তি আয়ের একটি মৌসুম ও মওকা। আর সে কারণেই কোনো সমন্বিত বা কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাপনায় পরীক্ষা পদ্ধতি গ্রহণ করা হয় না। জাতিবিনাশী এরূপ জঘন্য ও বাজে চিন্তা কারো মাথায় থাকলে তা ঝেড়ে ফেলার ব্যবস্থা করতে হবে। পরবর্তী কাজ হবে প্রশ্ন প্রণয়ন, মডারেশন, কম্পিউটার কম্পোজ, মুদ্রণ, সংরক্ষণ ও বিতরণের মতো প্রতিটি স্তরের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা।
প্রশ্নপত্র ফাঁসে ভবিষ্যত প্রজন্ম বুদ্ধিবৃত্তিক পঙ্গুত্বের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। প্রশ্নপত্র ফাঁস ঠেকানো কি এতো জটিল? সরকার কেন এত বিশাল জনগোষ্ঠীকে নির্বুদ্ধিতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এমনিতেই দেশের শিক্ষার মান নিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আমরা লজ্জিত। বিশ্বের সেরা ২ হাজার ইউনিভার্সিটির মধ্যে বাংলাদেশের কোনো ইউনিভার্সিটির নাম নেই। মালোয়েশিয়া, ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, কোরিয়া, তুরস্ক, ভারত এমনকি পাকিস্তানেরও একাধিক ইউনিভার্সিটি এই তালিকায় আছে। নোবেল বিজয়ী মালালা ইউসুফজাঈ আমেরিকার স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে ভর্তির জন্য আবেদন করলেও ইউনিভার্সিটি কর্তৃপক্ষ তাকে বলেছে ভর্তি পরীক্ষা দিয়েই উত্তীর্ণ হতে হবে, নোবেল কোটা কোনো কাজে আসবে না। অথচ আমাদের দেশে এমন ঘটনাও রয়েছে, ভর্তি পরীক্ষায় ফেল করেও শুধুমাত্র টিচারের মেয়ে হওয়ায় ভর্তির সুযোগ পেয়েছে। এছাড়া দেশে উপজাতি কোটা, খেলোয়ার, মুক্তিযোদ্ধা, পোষ্য, নারী কোটাসহ রাজনৈতিক ব্যাপারতো আছেই।
কী ভয়াবহ একটি অপরাধ আজকে আমাদের গাসহা হয়ে গেছে! শিক্ষা মন্ত্রণালয়, তথা সরকারেরও যেন এ ক্ষেত্রে কিছুই করার নেই, তাদের গাসহা ভাবও চোখে পড়ার মতো। মানুষকে অপরাধ থেকে নির্বৃত্ত করতে দরকার আইন ও তার যথাযথ প্রয়োগ। এ দায়িত্ব পুরোপুরিই সরকারের। কিন্তু আমাদের প্রায় সব সরকার এ ক্ষেত্রে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। প্রশ্ন ফাঁসের সঙ্গে জড়িত কোনো ব্যক্তির আদালতে বিচার হয়েছে কি?
লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক
সম্পাদনা : মোহাম্মদ আবদুল অদুদ