জাতিসংঘের ভোট এবং আবেগের সুকুমারবৃত্ত
রোহিঙ্গা ইস্যুতে ভারত বাংলাদেশের স্বার্থ দেখেনি। রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়া এবং নাগরিকত্ব দেওয়ার প্রস্তাব বিষয়ে জাতিসংঘের ভোটে নিরব ছিল দেশটি। ভোটে ১৩৫টি দেশ প্রস্তাবটির পক্ষে সায় দিয়েছে। বিপক্ষে গেছে চীন, রাশিয়াসহ ১০টি দেশ। ভারতসহ ২৬টি দেশ ছিল তথাকথিত নিরপেক্ষ জোনে। ভারত বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের জন্য একটি ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনা করে এবং এই কার্যক্রমের নাম ‘ইনসানিয়াত’। প্রশংসাজনক এমন কার্যক্রমের বিপরীতে স্বভাবতই প্রশ্ন উঠে, মজলুমের প্রতি জুলুমের প্রতিকার দেওয়া কী ‘ইনসানিয়াত’ নয়, হত্যা-ধর্ষণ-দেশছাড়া করার প্রতিবাদ করা কী ‘ইনাসানিয়াত’ নয়? না কী এসব ক্ষেত্রে ‘ইনসানিয়াত’ শুধু ‘বাত কি বাত!
জিও-পলিটিক্সে বন্ধু বলে কোনো শব্দ আদৌ কী আছে! নাই। রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে কী কখনো বন্ধুত্ব হয়? হয় না। যা হয়, তা হলো ‘পার্টনারশিপ’। প্রাপ্ত বয়স্কদের ভাষায় বলা যায়, সেক্স পার্টনার। যতদিন আনন্দদায়ক, ততদিন ‘লিভ টুগেদার’, তারপর ‘রাস্তা মাপ’। জিও-পলিটিক্সে এটাই বাস্তবতা, মানুন আর না মানুন। বিশেষ করে বর্তমান বাণিজ্যকরণের যুগে, ‘কর্পোরেট’ পৃথিবীতে অর্থনৈতিক স্বার্থটাই অগ্রগণ্য। খানিকটা ‘গণিকাবৃত্তি’র মতন, ‘পয়সা হজম, খেলা খতম’। আবেগের চোটে ‘বন্ধু’ বলতে ‘নন্দু’ হবার, প্রেমে হাবুডুবু খাওয়ার আগে এ বিষয়গুলি ভেবে দেখা দরকার।
যুক্তরাষ্ট্র আর ভারতের সামরিক চুক্তির পর বলেছিলাম, দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিকে কেন্দ্র করে বিশ্ব রাজনীতির একটি পরিবর্তন ঘটতে যাচ্ছে। ‘আরাকান ক্রাইসিস’ নিয়ে বলেছিলাম, আরেকটি মোচড় খেতে যাচ্ছে বিশ্বরাজনীতি। দুক্ষেত্রেই যোগ করেছিলাম এর হাওয়া বাংলাদেশেও লাগবে। ‘মার্গীয়’ বুদ্ধিজীবীরা বিষয়টিকে অতি উৎসাহ বলে তাচ্ছিল্য করেছিলেন সেসময়। এখন তাদের অনেকেরই হাহুতাশন দেখি, আর তাদের ‘কী করিব’ জাতীয় বন্ধুত্বের আকুলতায় বেদনাহত হই।
রাষ্ট্র পরিচালনার প্রথম শর্ত হলো আবেগ বর্জন, রাষ্ট্র নিয়ে আলোচনার প্রধান শর্তও তাই। ‘রাগ বিরাগের’ ঊর্ধ্বে উঠেই রাষ্ট্র বিষয়ক কথকতা হওয়া উচিত। সময়ের সাথে রাষ্ট্রের প্রয়োজন বদলায়, স্বার্থও বদলায়। সেই প্রয়োজনীয় স্বার্থই করণীয় নীতি নির্ধারণ করে। কেউ যদি মনে করেন, ভোটদানে বিরত থাকা নিয়ে ভারতের অবস্থানের সমালোচনা এবং পাকিস্তানের পক্ষে ভোট দেওয়া নিয়ে আলোচনা করার অর্থ হলো হৃদয়ে কথিত ‘পাকি প্রেম’ বা ‘ভারত বিরোধীতা’ লালন করা, তাহলে তারা ‘রাগ-বিরাগের’ উর্ধ্বে উঠতে না পারা মানুষ। বলতে পারেন, এই ধরণের চিন্তা অনেকটাই ‘ফ্যাটিডিকাল’।
এমন ধারার বেশ কিছু বক্তব্য ও বিশ্লেষণ দেখলাম সামাজিক ও গণমাধ্যমে। এসব বক্তব্যে ও বিশ্লেষণে অনেকটা জোর করেই নির্মোহ অবস্থানে থাকাদের ‘পাকি প্রেমি’ তকমা এটে দেওয়া হচ্ছে। তাদের বিশ্লেষণকে আখ্যা দেওয়া হচ্ছে ‘ভারত বিরোধীতা’ বলে। এমনসব ‘ফ্যাটিডিকাল’দের জন্য গত ১২ অক্টোবর মানবজমিনে প্রকাশিত সংবাদের কিছু অংশ তুলে দিই, ‘বাস্তচ্যুত মিয়ানমার নাগরিকদের রাখাইনে তাদের বসতভিটায় ফেরত পাঠানো নিশ্চিত করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে পাকিস্তানকে যুক্ত হওয়ার অনুরোধ জানিয়েছে বাংলাদেশ। গত মঙ্গলবার ইসলামাবাদে পাকিস্তানের নবনির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী শাহীদ খাকান আব্বাসীর সঙ্গে দেখা করে দেশটিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার তারিক আহসান এ অনুরোধ জানান। হাইকমিশনের পক্ষ থেকে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।’ জাতিসংঘে ‘রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়া ও নাগরিকত্ব দেওয়া’র প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিয়ে পাকিস্তান তো সেই অনুরোধই রক্ষা করেছে। আপনাদের ‘ফ্যাটিডিক’ মতবাদের ভাষায় এহেন অনুরোধের কারণে অনুরোধকারীদেরকেই তো ‘পাকি প্রেমি’ বলতে হয়!
এমনসব লিখিয়েরা সত্যিকার অর্থেই কী ‘রাষ্ট্র’ ব্যাপারটি বোঝেন? আমার মতন ক্ষুদ্র বুদ্ধির মানুষেরও মাঝেমধ্যে সন্দেহ জাগে। একটি ‘স্বাধীন’ রাষ্ট্রের কোনো স্থায়ী বন্ধু নেই, ঠিক তেমনি দীর্ঘস্থায়ী শত্রুও নেই। এটা ‘মানবজনম’ নয় যেখানে ‘লেঙ্গুটিয়া’ দোস্ত থাকবে। রাষ্ট্রের জন্ম হয় রাজনৈতিক কারণে, আবেগের কারণে নয়। সেজন্যেই রাষ্ট্র পরিচালনায় শপথের মধ্যে উদ্ধৃত থাকে ‘রাগ-বিরাগে’র ঊর্ধ্বে থাকার ব্যাপারটি। কিন্তু যারা ‘ঊর্ধ্বে’ না উঠে হৃদয়ের আবেগ আর রাষ্ট্রের নির্মোহতা এক করে ফেলেন, তাদের উদ্দেশ্যে তো বলাই যায়, ‘আপনাদের এই সুকুমার আবেগ লইয়া একটি রাজনৈতিক জাতি কী করিবে?’ তারা কবে বুঝবেন, ভারত তার নিজ স্বার্থের দিকে চাইবে, পাকিস্তানও তাই। চীন, রাশিয়া তো সারা পৃথিবীকে গ্রাসিতে উদগ্রীব। সুতরাং যেখানে তাদের স্বার্থ সেখানেই যাবে। যুক্তরাষ্ট্র আজন্ম তাই করে এসেছে। কিন্তু এখানে বাংলাদেশের ভূমিকা কী? ‘রাগ বিরাগের ঊর্ধ্বে’ উঠে আমরা কতটুকু কী করতে পেরেছি? কথায় কথায় ‘অমুক প্রেমি’, ‘তমুকের দালাল’ এমনসব ফেনায়িত আবেগ আমাদের কোথায় পৌঁছাল? আপনারা কবে বুঝবেন যে, আবেগ বাড়লে, বিবেক থমকে যায়। আদৌ কী বুঝবেন আপনারা! না কী ‘সাবসে পেহলে’ নিয়েই ‘দিলখোশ’ থাকবেন!
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট
সম্পাদনা : আশিক রহমান ও মোহাম্মদ আবদুল অদুদ