তিন দশকে দারিদ্র্যতা হ্রাস পেয়েছে ২৬ ভাগ
বাংলাদেশের জনসংখ্যা সাড়ে ১৬ কোটি, যা ফ্রান্স, জার্মানি এবং নেদারল্যান্ডসÑ ইউরোপের এই তিন দেশের মোট জনসংখ্যার থেকেও অনেক বেশি। বিশ্বের মোট জনসংখ্যার দিক বিবেচনায় বাংলাদেশের অবস্থান ১০ম। দেশটির অধিকাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করত। ক্ষুদ্র আয়তন এবং এর দারিদ্র্যতা স্বত্বেও বিগত তিন দশকে এর অর্থনীতি ব্যাপক প্রসার ঘটেছে। বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সুবাতাস বইছে বলা চলে। সার্কভুক্ত দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অর্থনীতি সুন্দর ও সুখকর সময় কাটাচ্ছে বলে এশীয় উন্নযন ব্যাংক (এডিবি) মনে করে। এডিবির মতে, ২০১৬ সালে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ছিল শতকার ৭ দশমিক ১০ ভাগ। ৩০ বছরে খুব দ্রুতগতিতে অর্থনৈতিক প্রসার ঘটেছে। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশে যখন অর্থনীতি স্থবির হয়ে পড়েছে তখন টানা ছয় বছর প্রবৃদ্ধি শতকরা ৬ ভাগেরও বেশি অর্জন, বাংলাদেশের জন্য অবশ্যই বড় অর্জন। অর্থনীতিবিদ এবং বিশেষজ্ঞরা বিশ্বাস করেন, সাফল্যের এই ধারাবাহিকতা বজায় থাকবে। বিশ্ব অর্থনীতি বিষয়ক রেটিং ফার্মস মুডি মনে করে, বাংলাদেশের এই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সেটা আরও প্রসারিত হবে এবং সুষ্ঠুভাবে বজায় থাকবে। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে দ্রুত যে প্রসার ঘটছে তাতে খুব বেশি পুলকিত হওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই, এর সুফল যদি দরিদ্র মানুষরা না পায়, তাহলে দারিদ্র্যের অতল গহবরে হারিয়ে যাবে। সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্ব ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০০৫-১০ পর্যন্ত শতকরা ৪০ ভাগ দারিদ্র লোকের আয় বৃদ্ধি পেয়েছে শতকরা শূন্য দশমিক ৫০ ভাগ। এই একই সময়ে ভারতের সাথে তুলনা করা হলে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি এবং মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি পেয়েছে। ৩০ বছরে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ফলে দারিদ্র্যতা হ্রাস পেয়েছে শতকরা ২৬ ভাগ। দ্রুত প্রবৃদ্ধির ফলে দারিদ্র্যতা কমছে, আশা করা যাচ্ছে আগামী ২৩ বছর পর বাংলাদেশ অর্থাৎ ২০৪০ সালে বাংলাদেশ উন্নত বিশ্বের মতো অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত হবে। আজ থেকে ২৬ বছর আগে ১৯৯১ সালে মোট জনসংখ্যার শতকরা ৪০ ভাগ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করত। বর্তমানে সেই সংখ্যা শতকরা ১৪ ভাগে এসে দাঁড়িয়েছে। দারিদ্র্যতা হ্রাস পেয়েছে শতকরা ২৬ ভাগ। ৩০ বছর আগে মোট জনসংখ্যার প্রায় ৫ কোটি মানুষ দ্রারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করত, বর্তমানে এই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২ কোটি ৩১ লাখে। অর্থনৈতিক কর্মকা-, কাজে কর্মে প্রসার ঘটানো এবং বহুমাত্রিক কর্মকা-ে জড়িয়ে পড়া, কাজের বৈচিত্র্য সৃষ্টির কারণেই বেকারত্ব হ্রাস পেয়েছে, দারিদ্র্যতা কমেছে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পেছনে গবেষকরা মনে করেন, পোশাকশিল্পে নারী শ্রমিকের ব্যাপক কর্মসংস্থান এবং এনজিও দেশের বেকারত্ব হ্রাসে অবদান রেখেছে। দুই বছর আগে ২০১৫ সালে পোশাকশিল্প খাতে বাংলাদেশ ২ হাজার ৬০০ কোটি ডলারের পোশাক রফতানি করেছে, যা মোট জিডিপির শতকরা ১৪ ভাগ এবং সব ধরনের পণ্য রফতানি ক্ষেত্রে শতকরা ৮০ ভাগ। ২০১৬ সালে পোষাকশিল্প খাত থেকে আয় আরও শতকরা ১০ ভাগ বেশি আশা করা হয়েছিল। অবকাঠামোগত দুর্বলতা এবং সরকারি খাতে নানা রকম জটিলতা স্বত্ত্বেও শিল্প খাতে বিশেষ করে পোশাক খাতে অসাধারণ অবদান রেখে চলেছে। যদিও পোশাক খাতে শ্রমিকরা বিশেষ করে নারী শ্রমিকরা নানা রকম বৈষম্যের শিকার হয়ে থাকেন। তাদের পারিশ্রমিক নিয়ে মালিক শ্রেণির সঙ্গে নিয়মিত চলে দ্বন্দ্ব ও সংঘাত। এরই পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের শ্রম মন্ত্রণালয় কর্তৃক সর্বনি¤œ মজুরি নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। বিশ শতাব্দীর ৭০ দশকে যুক্তরাষ্ট্র সরকার পোশাকশিল্প খাতে কোটা প্রথা চালু করে, এর উদ্দেশ্য ছিল নিজ দেশের বস্ত্র খাতকে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা থেকে রক্ষা করা, বিশেষ করে সেই সময় দক্ষিণ কোরিয়ার পোশাকশিল্প খাত ব্যাপক প্রসার ঘটেছিল, তাদের সাথে প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হতে চায়নি যুক্তরাষ্ট্র। এই কোটা প্রথা চালু করে একদিক থেকে লাভবান হয়েছে বাংলাদেশ। কোটা চালু হওয়ার কারণে দক্ষিণ কোরিয়ার পোশাকশিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাদেশে নানা রকম শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলল। এর ফলে বাংলাদেশের পোশাকশিল্পের দ্রুত প্রসার ঘটতে শুরু করে, দেশে কর্মসংস্থানে বড় ধরনের বিপ্লব ঘটে যায়। ব্যবসায়ী সম্প্রদায় বস্ত্র খাতে অভিজ্ঞদের সমন্বয় ঘটায়, এক পর্যায়ে তারা নিজেরাই পোশাকশিল্পের ব্যবসায়ের সঙ্গে যুক্ত হয়। বাংলাদেশের দারিদ্র্যতা দূরীকরণে এনজিগুলো অসামান্য অবদান রেখেছে, যদিও একথা সত্য ক্ষুদ্রঋণ খুব বেশি দারিদ্র্যতা দূর করতে পারেনি কিন্তু এটাও সত্য, ক্ষুদ্র ঋণের মাধ্যমে অনেকেই ব্যবসাবাণিজ্য করে স্বাবলম্বী হয়েছেন। বাংলাদেশের বিশাল জনগোষ্ঠী যাদের অধিকাংশই তরুণ। এই তরুণদের সঠিক পথে কাজে লাগাতে পারলে বিশ্ব অর্থনীতিতে অবদান রাখতে পারবে। বিশেষ করে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে জনগোষ্ঠীকে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে হবে। সরকারের পাশাপাশি ব্র্যাক স্বাস্থ্য খাতে বিশেষ অবদান রেখে চলেছে। এইসব দিক বিবেচনা করলে মানব উন্নয়ন সূচকে ভারতের থেকে উন্নত অবস্থায় রয়েছে বাংলাদেশ। নারী-পুরুষ শ্রম বৈষম্য অনেকটাই হ্রাস করতে পেরেছে বাংলাদেশ।
লেখক : উন্নয়ন কর্মী
সম্পাদনা : খন্দকার আলমগীর হোসাইন