মাইনাসে মাইনাসে যখন প্লাস হয়
ঘরের ছেলে বেয়াদবী করলে যা হয় তা-ই ঝুটেছে সিন্হার ভাগ্যে। অন্যদিকে শত্রুর পাথরের আঘাত সহ্য করা গেলেও বন্ধুর ফুলের আঘাত সহ্য করা যায় না। লাইলী মজনুর প্রেম কাহিনীতে একথাই বলা হয়েছে। আওয়ামী সরকারের আপনজনা হিসেবে প্রধান বিচারপতি পদ তিনি অলংকৃত করেছিলেন, এখন যারা তাকে কলঙ্কিত করেছেন, তারাই যারা (সরকার) সিনহার লালন পালন ও নিয়োগ কর্তা। ঘরের ছেলে অযোগ্য হলেও যোগ্য, সে হিসেবে শান্তি কমিটির সদস্যকে সরকার যোগ্য মনে করেছেন, যদিও শান্তি কমিটিতে সম্পৃক্ততা থাকার কারণে অনেকের প্রাণ সিনহার হাতেই পরকালে চলে গেছে।
সরকারের রক্ত চক্ষুকে উপেক্ষা করে ১৩ অক্টোবর ২০১৭ তারিখে রাত্রে অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার পূর্বে প্রধান বিচারপতি সিনহার বক্তব্য প্রশংসার দাবি রাখে। তিনি দৃঢ়তার সাথে বলেছিলেন ‘আমি সম্পূর্ণ সুস্থ্য। পালিয়ে যাচ্ছি না, দেশে অবশ্যই ফিরে আসব।’ সিনহার উক্ত বক্তব্য দেশবাসী ও আন্তর্জাতিক বিশ্ব শুনেছে। সিনহার বক্তব্য যদি সত্য হয় তবে রাষ্ট্রপতির নিকট দাখিলকৃত অসুস্থ্যতার কারণে ছুটির দরখাস্ত মিথ্যা। অন্যদিকে বঙ্গভবন ও সরকারের বক্তব্য যদি সত্য হয় তবে প্রধান বিচারপতি মিথ্যা বলেছেন। বিষয়টি দিনের আলোর মতো সত্য যে, স্বাভাবিকভাবেই ধরে নিতে হবে যে, নিশ্চয় রাষ্ট্রপতি স্থির নিশ্চিত হয়েই ১১টি অভিযোগ আপীল বিভাগের বিচারপতিদের নিকট শুধু উপস্থাপন করেননি বরং উদ্দেশ্যে করেছেন তার বাস্তবায়ন হয়েছে। অতএব, সামাজিক আচার বিচারের মতো সিনহার বিচার আপিল বিভাগের বিচারপতিরা করে ফেলেছেন সিনহার সঙ্গে একত্রে না বসার ঘোষণা দিয়ে। (গ্রাম্য শালিসেও এখনো ‘একঘরে’ রাখা হয়। যেখানে যাকে ‘একঘরে’ করে রাখা হয় তার সাথে কেহ কোনো আচার অনুষ্ঠানে যোগ দেয় না, কোনো সামাজিক/পারিবারিক যোগাযোগ রাখাকে অপরাধ মনে করেন)। কিন্তু মি. সনহার আইনগত বিচার বা সাংবিধানিক পদ্ধতিতে বিচার কার্যক্রম শুরু হবে কি হবে না এটাও নির্ভর করে প্রধানমন্ত্রীর ‘অভিমানের’ গভীরতার উপরে।
বিচারপতি সিনহা এজলাসে বসে প্রকাশ্যে এমন কথাই বলতেন যা থেকে তার আপোষহীন চরিত্রের গুনাবলী লক্ষ্য করা গেছে। কিন্তু ঘটনা অথবা প্রভাব যাহাই হউক বিদেশ থেকে পদত্যাগের মাধ্যমে আপোষহীন সিনহার ‘আপোষহীনতার’ মৃত্যু ঘটেছে। নিরাপত্তা অথবা জেল হাজতের ভয়েই কি দেশে ফেরা তার সুদুর পরাহত? (যে ভাষায় বলেছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল, সে ভাষাতেই বলা হলো) তবে প্রধানমন্ত্রীর অভিমানে (সিনহার মতে) সিনহাকে যেমন দেশ ছাড়তে হয়েছে, অনুরূপ ‘পদত্যাগ’ প্রধানমন্ত্রীর অভিমানকে কতটুকু ধুয়ে মুছে ফেলেছে, তারই উপর নির্ভর করবে সাবেক প্রধান বিচারপতি সিনহার দেশে ফেরা না ফেরা বা জেলে যাওয়া না যাওয়া।
২১ জানুয়ারি ২০১৮ তারিখে ৬৭ বৎসর পূর্ণ হওয়ার সাথে সাথেই সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৯৬(১) মোতাবেক বিচারপতি সিনহার স্বাভাবিক নিয়মে অবসরে যাওয়ার কথা। সরকারি ভাষ্যমতে ০২ অক্টোবর ২০১৭ তারিখে তিনি শাররিক অসুস্থ্যতার জন্য এক মাসের ছুটিতে গিয়েছেন। ‘অসুস্থ্যতার’ বিষয়টি যে মিথ্যা তার প্রমাণ ১৩ অক্টোবর ২০১৭ তারিখে নিজ স্বাক্ষরিত ও নিজ হাতে বিলিকৃত প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে দৃঢ়তার সাথে প্রকাশ করেছেন, তখনো তিনি বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি। সিনহা ১০ নভেম্বর ২০১৭ তারিখে দেশে ফেরার বিষয়টি বার বার মিডিয়াতে নিশ্চিত করলেও ০৯ নভেম্বর ২০১৭ তারিখে সিঙ্গাপুর দূতাবাসের মাধ্যমে প্রধান বিচারপতির পদ থেকে ‘পদত্যাগ’ করেছেন যা রাষ্ট্রপতি কর্তৃক অনুমোদিত হয়ে ১৪ নভেম্বর ২০১৭ তারিখে পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণের আইন মন্ত্রণালয়ে প্রেরিত হয়েছে। সরকার বলছে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ, বিরোধীদের দাবি প্রচ- চাপের মুখে এই পদত্যাগ। এ চাপটি কি তা খুজে বের করা দরকার, নতুবা প্রধান বিচারপতি বিদায়ের যে কলঙ্কিত নজির সৃষ্টি হলো তা মুছা যাবে না। মি. সিনহা আমাদের মতো বোমা বিস্ফোরণ, অগ্নিসংযোগ বা খুনের মামলার আসামি নন। তাছাড়া দেশে ফিরলে সিনহাকে হত্যা বা রিমান্ডের নামে তারেক রহমানের মতো রিমান্ডে নিয়ে মেরুদ- ভাঙার সম্ভাবনা নেই। তবে কি দুদকের ১২৬টি অভিযোগ এবং রাষ্ট্রপতির নিকট দুর্নীতির ১১টি প্রমাণপত্র বা প্রধানমন্ত্রীর অভিমানই ‘চাপ’ নামক অস্ত্র হিসাবে ব্যবহ্নত হয়েছে? নাকি ‘পদত্যাগ’ পত্রটি ‘আপোষের’ হাতিয়ার হিসাবে কার্যকর হয়েছে? যদি তাই হয় তবে এটাই প্রমানিত যে, ‘দুর্নীতির’ সাথে রাষ্ট্রপতির নেতৃত্বে রাষ্ট্রও আপোষ করতে পারে। যে যে অবস্থায় থাকুক না কেন, রাষ্ট্রকে অবশ্যই স্বচ্ছ হতে হবে। সে স্বচ্ছতা প্রমাণের দায়িত্ব রাষ্ট্রের। দূদক তো সরকারের ক্রীড়ানক হিসাবে পূর্বেও ছিল, বর্তমানেও এর ব্যতিক্রম নেই, বরং সরকার প্রীতি নগ্নভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ব্যাপক চুরি ও আতœসাতের জন্য বেসিক ব্যাংকের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দুদক মামলা করলেও ব্যাংকের চেয়ারম্যান আ. হাই বাচ্চু ধরা ছোঁয়ার বাহিরে, কারণ তিনি প্রধানমন্ত্রীর কাছের লোক।
উল্লেখ্য, বিচারপতি জয়নুল আবেদীনের সম্পত্তির হিসাব চেয়ে দুদক ১৮ জুলাই ২০১০ তারিখে একটি নোটিশ প্রদান করে। প্রধান বিচারপতি সিনহার নির্দেশে সুপ্রীম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলের অফিস থেকে বিচারপতিদের বিরুদ্ধে দুদক তদন্ত না করার জন্য নির্দেশনামূলক চিঠিকে ১৪ নভেম্বর ২০১৭ তারিখে প্রদত্ত এক রায়ে বিচারপতি এম. এনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি সহিদুল করিম সমন্বয়ে গঠিত হাই কোর্ট ডিভিশন ব্যাঞ্চ বাতিল ঘোষণা করেছেন। ফলে সিনহার ১২৬টি অভিযোগের তদন্ত করতে অন্য কোনো বাধা নেই, প্রধানমন্ত্রীর অন্যরূপ নির্দেশ ব্যতিত।
‘অভিমান’ এর সমাপ্তি যদি পদত্যাগের মাধ্যমে হয়ে থাকে তবে বিদায়ী প্রধান বিচারপতি সিনহা জাতীয় সংসদকে উওঝ ঋটঘঞওঙঘঅখ বলে যে মন্তব্য করেছেন তার সূরাহা হবে কিভাবে? তবে কি উওঝ ঋটঘঞওঙঘঅখ হওয়ার রায় হতে পারে মর্মে প্রধানমন্ত্রীর ‘ভয়’, অন্যদিকে দুর্নীতির মামলায় জড়িয়ে যাওয়ায় প্রধান বিচারপতির ভয় (!)- দুজনার ‘ভয়’ কি এখানে আপোষ ফর্মুলা তথা ‘পদত্যাগ’ নামক অস্ত্রের মাধ্যমে স্বস্থির নিঃশ্বাস নির্গম করেছে? ভয়কে ‘জয়’ করার জন্যই কি ‘পদত্যাগ’ নামক এই আপোষনামা? যদি তাই হয় তবে কেহ কারো মানসম্মানে হাত না দেওয়ার ‘পদত্যাগে’ জাতি কতটুকু লাভবান?
এ্যালজেবরার থিউরি যথা মাইনাস + মাইনাস = ইজিকেল টু প্লাস (- + – = +) থিউরির বাস্তবায়ন এখানে হয়েছে বলে প্রতিয়মান হচ্ছে। উরংভঁহপঃরড়হধষ হওয়ার ভয় প্লাস দুদকের মামলায় আসামি হওয়ার ভয় ‘পদত্যাগে’ নিষ্পত্তি হয়েছে ধারণা করা যাচ্ছে। তবে এ ঘটনার যে কলঙ্কিত নজীর সৃষ্টি হলো এ জন্য কে দায়ী বঙ্গভবন না বিচার বিভাগ?
লেখক : কলামিস্ট ও বিএনপির চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা
ঊ-সধরষ: ঃধরসঁৎধষধসশযধহফধশবৎ@মসধরষ.পড়স
সম্পাদনা : আশিক রহমান ও মোহাম্মদ আবদুল অদুদ