বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণটি পৃথিবীর প্রত্যেকটি বড় বড় ভাষায় অনুবাদ করা দরকার
অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান
সারা পৃথিবীতে সংখ্যালঘু অর্থ্যাৎ ক্ষুদ্র, দুর্বল জাতিগোষ্ঠী ওপর যে অত্যাচার-অনাচার হয় সংখ্যাগরিষ্ঠ লোক দ্বারা তাদের মুক্তির কথা এখানে বলা হয়েছে। বাঙালি-অবাঙালি, হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সবাই আমরা বাঙালি এবং এদের সকলের হেফাজতের দায়িত্ব হচ্ছে সংখ্যাগরিষ্ঠ লোকদের।
আজকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছোট ছোট সম্প্রদায়, জাতিগোষ্ঠির উপর যে নির্যাতন হচ্ছে, সেই জায়গাতেও একটা প্রতিবাদী বক্তব্য বঙ্গবন্ধুর ভাষণে রয়েছে। যার কারণে, এই ভাষণ ১৯৭১ সালে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছিল। বর্তমানেও সারা পৃথিবীতে যারা নির্যাতিত হচ্ছে বৃহৎ জনগোষ্ঠির দ্বারা, যারা মুক্তিসংগ্রামের আন্দোলন করছে, তাদের জন্যও বঙ্গবন্ধুর এই বক্তব্য কার্যকরি ভূমিকা পালন করে। যে কোনো ধরণের সংকট আলোচনার মাধ্যমে, সমঝোতার মাধ্যমে, নিষ্পত্তি করা কোনো যুদ্ধে না যাওয়া এটাও বঙ্গবন্ধুর ভাষণে উল্লেখ করা আছে। বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে বলেছেন ‘আমরা জীবন দিয়ে চেষ্টা করেছি’ অর্থ্যাৎ পাকিস্তানী শাসকরা যাতে আপোষে ক্ষমতা হস্তান্তর করে অথবা দু-দেশের মধ্যকার সমস্যা যদি আপোষে মীমাংসা হয়ে যায়, সেটার জন্য তিনি জীবন দিয়ে চেষ্টা করেছেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু বলেছেন ‘তারা আমাদের কথা রাখেনি’। যে কোনো সাংগঠনিক অবস্থায় যুদ্ধ ঘোষণা করা, যুদ্ধের মাধ্যমে সমস্যা সমাধান করার চেয়ে আলোচনাটাকেই প্রাধান্য দিতেন বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধুর ভাষণে আরেকটা উল্লেখযোগ্য বিষয় রয়েছে সেটা হলো পৃথিবীতে যে সকল দেশ এখনও স্বাধীনতা সংগ্রামের চেষ্টা করছে এদেরকে বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে আখ্যায়িত করা, এবং পৃথিবীর অন্যান্য দেশ সেই বিচ্ছিন্নতাবাদকে সমর্থন না করার যে একটা সম্ভাবনা রয়েছে, সেটা কিন্তু জাতির জনক ১৯৭১ সালেই বুঝতে পেরেছিলেন। যার কারণে সেই সময়ে অনেক উদ্দীপ্ত জনতাই মনে করেছিল যে, ৭ মার্চেই স্বাধীনতা ঘোষণা করবেন বঙ্গবন্ধু। এখনও অনেকেই লেখালেখি করে বলার চেষ্টা করেন, যদি ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করতেন, তাহলে সহজেই আমাদের দেশ স্বাধীন হয়ে যেতো, এতোটা রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয়তো হতো না।
বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত দুরদর্শী চিন্তার অধিকারী ছিলেন। বঙ্গবন্ধু তখনকার সামাজিক, রাজনৈতিক, ভূ-রাজনৈতিক এবং আন্তর্জাতিক সকল প্রেক্ষাপট তার মাথায় ছিল যার কারণে তিনি একতরফাভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা করেননি। তখন একতরফাভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা করলে আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনকে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন হিসেবে চিহ্নিত করে, আত্মঘাতি সম্প্রদায় এটার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যেতো। যার প্রমাণ এখন আমরা দেখতে পাচ্ছি। গত মাসেই কাতালোনিয়া অর্থ্যাৎ স্পেনের একটা অঞ্চল একতরফাভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা করলো এবং শেষ পর্যন্ত সেই স্বাধীনতা ঘোষণাকারী নেতাকে পালিয়ে যেতে হলো। এমনকি বিশ্বের একটি দেশও তাদের এই স্বাধীনতাকে সমর্থন করেনি। বঙ্গবন্ধু তখন যদি স্বাধীনতা ঘোষণা করতেন, আমাদেরও একই অবস্থা হতো। কারণ, আমাদেরও আন্তর্জাতিক পরিম-লে স্বাধীনতা আন্দোলনকে ভিন্নরুপে প্রদর্শন করা হতো। ১৯৭১ সালের ৭ ডিসেম্বর যখন বাংলাদেশের স্বাধীনতার ব্যাপারে জাতিসংঘে ভোটাভোটি হচ্ছিল, সেখানে ১১০টি দেশ বাংলাদেশের বিপক্ষে ভোট দিয়েছিল, আর মাত্র দশটি দেশ আমাদের পক্ষে ভোট দিয়েছিল। ভারতসহ আরও কয়েকটি ছোট রাষ্ট্র আমাদের সমর্থন করেছিল। বঙ্গবন্ধু যদি ৭ মার্চের ওই দিনে হঠকারীদের চাপে পরে বা হঠকারীদের পরামর্শে স্বাধীনতা ঘোষণা করতেন, তাহলে আমাদের স্বাধীনতারও একি অবস্থা হতো, যেটা সাম্প্রতিককালে কাতালোনিয়ায় আমরা দেখতে পেলাম। আমি মনে করি, বঙ্গবন্ধুর এই ঐতিহাসিক ভাষণটি পৃথিবীর প্রত্যেকটি বড় বড় ভাষায় অনুবাদ করা হোক। এই অনুবাদ যদি করা যায় তাহলে ওয়ার্লড হেরিটেজের ডকুমেন্টসগুলো ইতিমধ্যে স্বীকৃতি পেয়েছে ইউনেস্কোর মাধ্যমে, এগুলোর মধ্যে শ্রেষ্ঠ্য একটা ডকুমেন্টস হিসেবে সারা পৃথিবীর মানুষের কাছে অনন্তকাল টিকে থাকবে।
পরিচিতি : উপাচার্য, জগন্নাথ বিশ্বদ্যিালয়
মতামত গ্রহণ : সাগর গনি
সম্পাদনা : মোহাম্মদ আবদুল অদুদ