ফিরে আসুন বারী সিদ্দিকী, আপনার অপেক্ষায় বাংলাদেশ…
অভি মঈনুদ্দীন : রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে গুরুতর অসুস্থাবস্থায় আছেন এদেশের জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী বারী সিদ্দিকী। তার ফেরার প্রত্যাশায় দিন গুনছেন তার পরিবারের সদস্যসহ সারা বাংলাদেশের মানুষ। যে শিল্পীর কণ্ঠে মা, মাটি, দেশ উঠে আসে সেই প্রিয় শিল্পী যেন সুস্থ হয়ে আবার গানের ভুবনে ফিরতে পারেন সেই দোয়াই করছেন সবাই। কোনোভাবেই দেশের সঙ্গীতাঙ্গনের এমন রতœকে হারাতে চান না কেউ।
একজন বারী সিদ্দিকীকে আমাদের দেশে এই মুহূর্তে খুউব প্রযোজন বলেও অভিমত প্রকাশ করেছেন সঙ্গীতাঙ্গনের বিশেষ বোদ্ধারা। একজন বারী সিদ্দিকী হয়ে ওঠা সহজ কথা নয়। তাই তাকে মাত্র ৬৩ বছর বয়সে এই বাংলা হারাতে চায় না। আমরা তার ফেরার প্রত্যাশায় অপেক্ষারত। নিশ্চয়ই তিনি আমাদের মাঝে আবার ফিরে আসবেন।
বারী সিদ্দিকী। বাংলাদেশের একজন বিশেষজ্ঞ বংশীবাদক। সেইসঙ্গে তিনি ভাব ও মরমী ধারার এক অন্যরকম গায়কও বটে। নেত্রকোনায় ১৯৫৪ সালের ১৫ নভেম্বর বারী সিদ্দিকীর জন্ম। তার বাবা প্রয়াত মহরম আলী ও মা প্রয়াত জহুর-উন-নিসা। তিন ভাই এক বোনের মধ্যে বারী সিদ্দিকীই ছিলেন সবার ছোট। ছোটবেলায় বারী সিদ্দিকীর বয়স যখন তিন কিংবা চার হবে সেই বয়সেই মায়ের কাছে তার প্রথম শোনা গান ছিল ‘শ্বাশুড়িরে কইয়ো গিয়া’। সেই গানের সুরই বারীর মনে গেঁথে যায় ছোটবেলায়। যদিও তার পরিবার গানের পরিবার ছিল না। কিন্তু সৌখিন গানের পরিবার ছিল তার। বারীর নানা শেখ সাবির সরোদ বাজাতেন। আর তার নানীর কাছ থেকেই মা গান শিখেছিলেন টুকটাক। বারীর বয়স যখন পাঁচ তখন বড় ভাইয়ের বাঁশিতে ফু দেওয়া তার মধ্যে অন্যরকম আগ্রহের সৃষ্টি করে বাঁশি শেখার প্রতি।
বারীর নানারা দুই ভাই ছিলেন। তার নানার একটা সঙ্গীতের দল ছিল। বারীর বাবা গানের সঙ্গে জড়িত না থাকলেও গান বাজনা তার পছন্দের ছিল। বারী তার বাঁশি শেখা এবং গান শেখার দুটোরই উৎসাহ পেয়েছেন তার মায়ের কাছ থেকে। বারী ছোটবেলায় বাঁশি বাজাতেন মূলত বড় ভাইদের নকল করে। তখন পদ্ধতিগতভাবে নেত্রকোণায় বাঁশি শেখার উপায় ছিল না। তাই মাত্র ৭/৮ বছর বয়সেই মা জহুর-উন-নিসার কাছে গান শেখা শুরু করেন। মার কাছ থেকে জীবনে তিনি প্রথম যে গানটির সুর বাঁশিতে তুলে নিয়েছিলেন সেই সুরটিই তিনি পরবর্তীতে হুমায়ূন আহমেদের ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ চলচ্চিত্রে ব্যবহার করেছিলেন। সেটি ছিল শ্যাম বিচ্ছেদের একটি সুর। কলিটা ছিল এরকমÑ ‘আস্ট আঙ্গুল বাঁশের বাঁশি/ মধ্যে মধ্যে ছ্যাদা/ নাম ধরিয়া ডাকে বাঁশি/ কলংকিনী রাধা।
নেত্রকোনায় গ্রামের স্কুল থেকে বারী সিদ্দিকী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠ সমাপ্ত করেন। নেত্রকোণা গভর্নমেন্ট হাইস্কুল থেকে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের পাঠও সম্পন্ন করেন। তারপর কলেজ জীবন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স সম্পন্ন করেন। বারী সিদ্দিকী যখন হাইস্কুলে পড়তেন তখন থেকেই তিনি পদ্ধতিগতভাবে সঙ্গীত শেখা শুরু করেন নেত্রকোনা জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে। তার সঙ্গীতের ওস্তাদ ছিলেন শ্রী গোপাল দত্ত। সেসময় বড় দুই ভাই এবং রফিক মাহমুদ, বিপুল চৌধুরী, দুলাল দত্তনবীশ, হযরত আলীর কাছ থেকেও গানে সহযোগিতা পেয়েছেন। ছোটবেলায় মূলত সঙ্গীতশিল্পী হওয়ারই স্বপ্ন ছিল বারী সিদ্দিকীর। তার মা তাকে উচাঙ্গ সঙ্গীত শিখে তা বাঁশিতে ট্রান্সফর্ম করতে বলতেন। তার সঙ্গীতে প্রথম ওস্তাদ গোপাল দত্ত। পরে ১৯৮০ সালের দিকে ঢাকায় শুদ্ধ সঙ্গীত প্রসারের একটি অনুষ্ঠানে পরিচয় হয় ওস্তাদ আমিনুর রহমানের কাছে। তিনি বিমানের পাইলট ছিলেন। ভারতবর্ষের বিখ্যাত বংশীবাদক ওস্তাদ পান্না লাল ঘোষের শিষ্য ছিলেন। সেই আমিনুর রহমানের বাড়িতে থেকেই বাঁশিতে তালিম নিতে থাকেন দিনের পর দিন। সেখানে থেকেই তিনি ওস্তাদ তাগাল ব্রাদার্স, প-িত দেবেন্দ্র মুৎসুদ্দী, ওস্তাদ আয়েফ আলী খান মিনকারীর সান্নিধ্য পেয়েছিলেন বারী সিদ্দিকী। প-িত বিজি কারনাডের কাছেও বাঁশি শিখতে তিনি পুনে গিয়েছিলেন। এভাবে একসময় বারী শিল্পকলা একাডেমির আয়োজনে বাংলাদেশ রেডিও টেলিভিশনসহ সম্মিলিত একটি যন্ত্রসঙ্গীত প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অধিকার করেন। এর পরপরই তিনি দক্ষিণ এশীয় সার্ক ফেস্টিভ্যালে যান বাঁশি বাজাতে সরকারি সহযোগিতায়। এরপর ধীরে ধীরে তিনি আরো পরিচিত হয়ে উঠতে লাগলেন। বাঁশি বাজান উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত পরিবেশনের সঙ্গে বিভিন্ন স্থানে। হুমায়ূন আহমেদের এক জন্মদিনের অনুষ্ঠানে তার বাসায় যান বাঁশি বাজাতে। সেখানে বাঁশি বাজানোর পাশাপাশি গানও করেন তিনি। হুমায়ূন আহমেদ তাকে আরো গান গাইতে বলেন অনুষ্ঠানে। গান শুনে মুগ্ধ হন হুমায়ূন আহমেদ। ১৯৯৫ সালে বিটিভির ‘রং-এর বারৈ’ অনুষ্ঠানে প্রথম গান করেন বারী সিদ্দিকী। এর পরপরই হুমায়ূন আহমেদ তাকে ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ চলচ্চিত্রে গান গাইতে বলেন। চলচ্চিত্রের গানে আকাশছোঁয়া জনপ্রিয়তা পাওয়ার পরপরই বাজারে তার দুটি একক অ্যালবাম আসে। একটি ‘দুঃখ রইলো মনে’ এবং অন্যটি ‘অপরাধী হইলেও আমি তোর’। দুটি অ্যালবাই লুফে নেয় শ্রোতারা। সেই সময় ৮০/৯০ বছর পর উকিল মুন্সীর লেখা গান জনগণের কাছাকাছি নিয়ে আসতে পেরে বারী ছিলেন দারুণ উচ্ছ্বসিত।
বারী সিদ্দিকী সবসময়ই নিজেকে একজন বংশীবাদক হিসেবে পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন। একজন বংশীবাদক হিসেবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তিনি বাঁশি বাজিয়েই শ্রোতা-দর্শককে মুগ্ধ করেছেন। ১৯৯৯ সালে ফ্রান্সে ওয়ার্ল্ড ফ্লুট সম্মেলনে এই উপমহাদেশ থেকে তিনিই প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন। এটা ছিল বাংলাদেশের জন্য এক বিরাট অর্জন। একজন গায়ক হিসেবে জনপ্রিয়তা পাওয়ার আগে বারী সিদ্দিকী একজন বংশীবাদক হিসেবে বাঁশি বাজিয়েছেন দু’দশক ধরে। কিন্তু গায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার কণ্ঠশিল্পী হিসেবেই তিনি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গিয়েছেন।
বারী সিদ্দিকী ১৯৮৬ সালে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন ফরিদা ইয়াসমিনের সঙ্গে। ১৯৮০ সালে বারী সিদ্দিকী পেশাগতভাবে বাঁশি বাজানো শুরু করেন। ১৯৮৬ সালে প্রথম বিটিভিতে ‘সৃজন’ অনুষ্ঠানে বাঁশি বাজান। বারী সিদ্দিকী ‘মাটির পিঞ্জিরা’ নামের একটি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছিলেন। পরবর্তীতে তিনি ফেরারী অমিতের নির্দেশনায় ‘পাগলা ঘোড়া’ নাটকেও অভিনয় করেছিলেন। তবে অভিনয় করেছেন নিতান্তই অনুরোধে এবং শখের বশে।