সুষম আঞ্চলিক উন্নয়নের স্বার্থে যা করা দরকার
ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ : দেশের সার্বিক ও সমন্বিত উন্নয়ন অত্যন্ত প্রত্যাশিত বিষয়। এর মধ্যে যেটি সচারচর সর্বাগ্রে সামনে আসে তা হলো, উন্নয়নের নামে, উন্নয়ন বরাদ্দে আঞ্চলিক বৈষম্য কিংবা এমনকি আর্থ সামাজিক প্রেক্ষাপট প্রান্তরে অঞ্চলভেদে আইন ও ব্যস্টি কিংবা সমষ্টির অধিকারগত কোনো ব্যতয় বা ব্যতিক্রম ঘটে কিনা, ঘটলে তার মাত্রা ও প্রকৃতি কেমন। এ কথা অস্বীকারের জো নেই যে উন্নয়ন বরাদ্দের ক্ষেত্রে অঞ্চলভেদে সাধারণত গোষ্ঠী বা দলীয় বিবেচনা প্রাধান্য পায়। নানা গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা গেছে রাষ্ট্রের মিশন ভিশনের চেয়ে সরকারের সদিচ্ছার ওপর নির্ভর করে আঞ্চলিক উন্নয়ন। এটা ঐতিহাসিক সত্য যে, আর্থসামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে সরকার সৃষ্ট আঞ্চলিক বৈষম্যের অবসান আকাক্সক্ষাই ছিল পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের মূল লক্ষ্য ও প্রেরণা। তৎকালীন পাকিস্তানের নীতিনির্ধারক রাজনীতিক ও সামরিক বেসামরিক প্রভাবশালী আমলারা অধিকাংশই ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানি। এ সুবাদে ‘পূর্ব’ এর তুলনায় ‘পশ্চিম’ পাকিস্তানে তুলনামূলকভাবে বেশি উন্নয়ন হয়েছিল অঞ্চলভিত্তিক।
পশ্চিম পাকিস্তানেই সিংহভাগ বৈদেশিক সাহায্য ব্যবহার ও উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়িত হতো। অন্যদিকে বাংলাদেশ বা পূর্ব পাকিস্তান ছিল বরাবরই বরাদ্দ বঞ্চিত। এই বৈষম্যের কথা তোলেই বাংলাদেশের স্বাধীকার এবং স্বাধীকার থেকে স্বাধীনতা অর্জনের দাবি ওঠে, আকাক্সক্ষা জাগ্রত হয়। ইতিহাস খ্যাত ‘ছয় দফা’ দাবির অন্যতম মর্মবাণীও ছিলÑ ‘পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যেকার অর্থনৈতিক ও উন্নয়ন বৈষম্য দূর করার পথ ও পন্থা বের করতে হবে’। এ প্রেক্ষাপটেই শোষণ বঞ্চনা বৈষম্য দূরীকরণার্থে স্বাধীনতা অর্জনে পর বাংলাদেশে কেন্দ্রীভূত চিন্তা চেতনায় পরিকল্পনা কমিশন গঠন করা হয়। সব অঞ্চলের সমান সুবিধাপ্রাপ্তির কথা মাথায় রেখেই এই কেন্দ্রীয় ভাবনার মহামহিম কমিশন গঠিত হয়। এসব কথা কমিশন গঠনের গৌরচন্দ্রিকায় উদ্দেশ্য ও বিধেয় হিসেবে লেখা থাকলেও বাস্তবে দেখা যায় বশংবদ ভিন্ন চিত্র। সুবিধাপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে, দেখা গেল, প্রাক্তন পাকিস্তানের মতোই বিশেষ দল, মত, গোষ্ঠী, নেতা, কর্মকর্তা বা অঞ্চল প্রাধান্য পেতে থাকছে। যার ফলে দেশের উত্তর ও দক্ষিণ অঞ্চল দীর্ঘদিন অবহেলার শিকার হয়। যমুনা নদীর ওপর বহুমুখী সেতু নির্মাণে পর উত্তরবঙ্গে নানাবিধ উন্নয়ন প্রকল্প শুরু ও বাস্তবায়ন সহজ হচ্ছে। নির্মীয়মান পদ্মা সেতু চালুর ওপর নির্ভর করবে দেশের দক্ষিণ পশ্চিম অঞ্চলের সুষম উন্নয়ন। আমাদের সংবিধানে লেখা আছেÑ জন্মস্থান, বংশ, ধর্ম, অঞ্চল নির্বিশেষে সকলের সমান সুযোগ সুবিধা প্রাপ্তির মৌলিক অধিকার থাকবে। কিন্তু বাস্তবে মৌলিক অধিকার প্রাপ্তি প্রশ্নাতীত হয় না অনেক সময় ও ক্ষেত্রে। বশংবদ নানা জটিলতা ও অপারগতার কারণ তো রয়েছেই। যেকোনো আঞ্চলিক উন্নয়নের সুবিধা ক্ষমতাসীন দল ও নীতিনির্ধারক কর্মকর্তারা বেশি ভোগ করেন। সকলের মৌলিক অধিকার সমভাবে সুনিশ্চিতকরনের ক্ষেত্রে যা যথেষ্ট বিচ্যুতি বা ব্যতয় বলা যায়।
একসময় দেশের পিছিয়ে পড়া অঞ্চলের উন্নয়নের সমস্যা জানা এবং সে সবের প্রতিকার এর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। সে সময় গঠিত উচ্চপর্যায়ের কমিটির গবেষণা সমীক্ষায় দেখা গেল বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল সঙ্গে পদ্মার দক্ষিণ পশ্চিম পাড়ের জনগণ অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সামাজিক সৌভাগ্য অবগাহনে তুলনামূলকভাবে বেশ পিছিয়ে রয়েছে। পদ্মার ওপারে বিশেষত, বরিশাল ও খুলনায় উন্নয়নের ছোঁয়া পড়েছে বেশ কম। এমনকি বিদেশে শ্রমিক পাঠানোর ক্ষেত্রেও এই অঞ্চলের জনগোষ্ঠী যথেষ্ট বিলম্ব ও বৈষম্যের শিকার হয়েছে। অন্যদিকে চট্টগ্রাম বিভাগের চাঁদপুর, ফেনী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ঢাকার মুন্সিগঞ্জ তথা বিক্রমপুরের বাসিন্দারা বিদেশে চাকরির সুবিধা বেশি ভোগ করছেন। ফলে, খুলনা বা বরিশালের চেয়ে এসব অঞ্চলের মানুষের অর্থনৈতিক জীবনযাত্রার মান যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছে। অথচ শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে দেশের উত্তর ও দক্ষিণ পশ্চিম অঞ্চল তো পিছিয়েই, এডিপিতে এ সব অঞ্চরের উন্নয়ন প্রকল্প তালিকা তত্ত্ব তালাশেও দেখা গিয়েছে অবকাঠামোগত উন্নয়ন অভিযাত্রায় তারা যথেষ্ট পিছিয়ে।
বাংলাদেশের জিডিপি’র শতকরা ২৫ শতাংশ আসে উপকূলীয় অঞ্চল থেকে। এখানে রয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় গরান বন (ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট), দুটি প্রধান সমুদ্র বন্দর, বিশ্বের দীর্ঘতম আনব্রোকেন সী-বিচ। অথচ উপকূলীয় অঞ্চলের স্থায়ী উন্নয়নে কেন্দ্রীয়ভাবে বিশেষ মনোযোগের অভাব পরিলক্ষিত হয়। এক পর্যায়ে একটি উপকূল উন্নয়ন বোর্ড গঠনের কথা বলা হয়েছিল। কিছু কথা-বার্তা হলেও আলোর মুখ দেখেনি সে পরিকল্পনা। তার মূল কারণ একটাইÑ উপকূলীয় অঞ্চলের জনপ্রতিনিধি না সরকারে না প্রশাসনে শক্তিশালী ভূমিকায় ছিল বা আছে। বাংলাদেশের উপকূল বরাবরই উপদ্রুত ও সুবিধা বঞ্চিত রয়েছে। অতি সম্ভাবনাময় ও সম্পদশালী উপকূলীয় অঞ্চল এবং সেখানকার মানুষেরা রয়েছে এখনো অরক্ষিত। আইলা বা সিডরের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রায়শই এই অঞ্চলের মানুষকে মোকাবেলা করতে হয়। অভিযোগ ওঠে সিডর ও আইলাতে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের ক্ষতিপূরণ পেতেও সমস্যা হয়েছে। সুন্দরবনে ক্ষতিগ্রস্ত জীববৈচিত্র পুনর্গঠন পুনর্বাসন মনোযোগে রয়েছে সবিশেষ অপারগতা আর উ™£ান্ত উপেক্ষা। সবকিছুর মূলে রয়েছে ক্ষমতায়নের অসমতা, অপারগতা আর অঞ্চলভিত্তিক বৈষম্যের বিলাস।
লেখক : সাবেক সচিব এবং এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান