সাল্লি আলা মুহাম্মাদ গাজী মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম জাবির
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সমসাময়িক আরবের বিশেষত মক্কা ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকার ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক দৃশ্যাবলী কেমন ছিল। রাসূল (সা.) এর আগমনের বহুকাল পূর্ব থেকে পবিত্র কাবাগৃহ আল্লাহ্র ঘর হিসেবে সমগ্র আরববাসীর কাছেই ছিল পরম সম্মানিত। কিন্তু তাওহিদী বিশ্বাসের শ্রেষ্ঠতম ও প্রথমতম স্মারকগৃহ আল্লাহ্র এই ঘরকে কেন্দ্র করে নানা রূপ ও রূপান্তরের মধ্য দিয়ে তৈরি হয়েছিল এমন একটি ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক রূপরেখা, যার মধ্যে তাওহীদের নামগন্ধও ছিল না। বরং এই ধর্মীয় সংস্কৃতি ও উপাসনা শৈলীর প্রাণকেন্দ্র ও প্রাণসম্পদ হয়ে উঠেছিল নিরস্কুশ পৌত্তলিকতা। যে হজরত ইবরাহিম (আঃ) কুঠারাঘাতে আপন পিতা আজর কর্তৃক নির্মিত মূর্তিগুলোকে ধ্বংস করেছিলেন; তাওহীদের আমানত রক্ষাকল্পে যিনি হাসিমূখে প্রবেশ করেছিলেন নমরুদের জ্বলন্ত অগ্নিকুন্ডে যিনি একমাত্র আল্লাহরই ইবাদতের জন্য পুত্র ইসমাইলকে সাথে নিয়ে তৈরি করেছিলেন কাবাগৃহ: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দেখতে পেলেন সেই ইবরাহিম (আঃ) এর তাওহিদী ধর্মমত পরিত্যাগ করে মক্কাসহ সমগ্র আরব জড়িয়ে পড়েছে পৌত্তলিকতার নিদারুন জটাজালে। যে-তাওহিদকে প্রতিষ্ঠার জন্য আল্লাহপাক অসংখ্য নবী-রাসূল প্রেরণ করেছেন। এই ধরা পৃষ্ঠের রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম দেখলেন তার ছিটেফোটাও আর অবশিষ্ট নেই। তিনি দেখলেন খুবই নগন্য সংখ্যক ব্যক্তি যারা বহু কষ্টে ইবারাহিম (আ.) এর ধর্মমতের উপর প্রতিষ্ঠিত; কিন্তু পুরো আরবই মূর্তিপূজায় আপাদমস্তক আচ্ছন্ন। লাত-মানত, উজ্জা-হোবল ইত্যাদি কত নামের কত যে মূর্তি তার কোন ইয়ত্তা নেই। আর পবিত্র কাবাগৃহ ও তার চতুস্পার্শস্থ চত্বরও কত যে অসংখ্য মূর্তির সমারোহ পরিকীর্ণ, তারও কোনো সীমা সংখ্যা নেই। কেউ বলেন, তিনশত ঘাট, কেউ বলেন আরো বেশী। অথচ মানুষের জীবনে পৌত্তলিকতা ও অংশীবাদের চেয়ে বড় কোন জুলুম নেই। বড় কোন জাহেলিয়াতও নেই। এই জুলুম ও জাহেলিয়াতের অভিশপ্ত কারাগারে সমগ্র আরব বিশ্ব তখন বন্দী। বিবেকহীন অন্ধকারের সঙ্গে হাত মিলিয়ে যে অস্বাভাবিক সংস্কৃতি আরবদের মধ্যে গড়ে উঠেছিল, তা ছিল উলঙ্গপনা, মদ্যপান, জুয়া ভাগ্যগণনা, বেহায়াপনা ও অকথ্য অশ্লীলতা। বিনোদনের জন্য আরবদের কাছে কাব্যচর্চা ছিল সর্বাধিক প্রিয় ও মুখ্যবস্তু; এবং কাব্যরচনা ও কবিতার সমঝদার হিসেবে আরবদের খুব খ্যাতিও ছিল। আসলে আরবি ভাষা ও আরব্যজীবনের এটা একটা অসাধারণ বৈশিষ্টও বটে। কিন্তু প্রাক-ইসলামী যুগে আরব্য কবিতা পুরোটাই ছিল অশ্লীল।
ইমরুল কায়েসদের মত অনেক বড় বড় কবি ছিল, কিন্তু তাদের রচনার উপজীব্য ছিল শুধুমাত্র নারী, গোত্র গৌরব ও অশ্লীলতা এবং শুধু কবি ও কাব্য রসিকদের ক্ষেত্রে নয়, অশ্লীলতার নিকৃষ্ট অভিব্যক্তি সমাজের সর্বস্তরে এত ব্যাপক ও ভয়ংকর ভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল যে, এমনকি হজ্ব করতে এসেও ঢাকঢোল বাজিয়ে সম্পূর্ন অর্ধ উলঙ্গ অবস্থায় নারী পুরুষ একত্র নাচতে নাচতে পবিত্র কাবাগৃহ তওয়াফ করতো এবং এটাই ছিল তাদের সংস্কৃতি ও পুন্যসঞ্চয়ের গৌরবময় ধর্মীয় সংস্কৃতি। এই দুঃসহ, মানবতার জন্য ক্রন্দনরত এই অন্ধকার অভিশপ্ত পৃথিবীতে আগমন করলেন আল্লাহ-প্রেরিত রাসূল হজরত মোহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। তিনি আসলেন সমগ্র বিশ্বের আশীর্বাদ স্বরূপ ‘রাহমাতাললিল আলামীন’ রূপে আসলেন নিখাদ কল্যান ও সত্য শুভত্বের আলোকবর্তিকা হাতে। ‘ইন্না আরসালনাকা বিল হাক্কি বাশিরাউ ওয়া নাজীরা’ (সূরা বাকারা) তিনি আসলেন সত্যদ্বীনসহ সুসংবাদদাতা ও ভয়প্রদর্শন কারী রূপে। শুধু সুসংবাদবাহী ও ভয় প্রর্দশক হিসেবে নয়, অবতীর্ন হলেন সমগ্র মানবগোষ্ঠীর একমাত্র অনুসরণযোগ্য সার্বিক জীবনের সর্বোত্তম আদর্শরূপে।