তদন্ত কর্মকর্তা সরকারের আজ্ঞাবহ আদালতে খালেদা জিয়া
মাঈন উদ্দিন আরিফ ও মামুন আহম্মেদ খান : বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বলেছেন, জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার তদন্ত কর্মকর্তা হারুন অর রশীদ একজন অতি উৎসাহী ব্যক্তি। আওয়ামী লীগ সরকারের আজ্ঞাবহ কর্মকর্তা। তিনি বলেন, এই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা হারুন অর রশীদ ২০০৫ সালে দুদক থেকে চাকরিচ্যুত হন। যে কারণে তিনি আমাদের ওপর ক্ষিপ্ত ছিলেন। তারই ফলশ্রুতিতে আমাদের বিরুদ্ধে তাকে কাজে লাগানোর জন্য বেছে নেওয়া হয়।
গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর বকশীবাজারে বিশেষ জজ আদালতে হাজির হয়ে এই মামলায় আত্মপক্ষ সমর্থনের অসমাপ্ত বক্তব্য তুলে ধরার সময় তিনি এসব কথা বলেন। আত্মপক্ষ সমর্থন করে ৬ষ্ঠ দিনের মতো বক্তব্য তুলে ধরে আদালতে নিজেকে নির্দোষ দাবি করেন খালেদা জিয়া। জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় আত্মপক্ষ সমর্থনে আরও কিছুদিন বক্তব্য দিতে চাইলে আদালত আগামী ৩০ নভেম্বর মামলার পরবর্তী শুনানির দিন ধার্য করেন।
খালেদা জিয়া বলেন, দুদকের কর্মকর্তা হারুন অর রশীদ বিরাগের বশবর্তী হয়ে স্বার্থান্বেষী মহলের ইচ্ছা ও নির্দেশ অনুযায়ী আমার বিরুদ্ধে অনুসন্ধান করেন ও তদন্ত প্রতিবেদন দেন। আদালতেও আমার বিরুদ্ধে অসত্য সাক্ষ্য দেন। আমার প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দল জনসম্মুখে আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচারণা চালিয়ে ভাবমূর্তি ক্ষুণœ করছে। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত কোনো সম্পর্ক নেই। অথচ এই কর্মকর্তা আমার নামে মিথ্যা মামলা ও মিথ্যা জবানবন্দি দিয়েছেন।
খালেদা জিয়া বলেন, হারুন অর রশীদের নিরপেক্ষ অনুসন্ধান ও তদন্ত করার মতো নৈতিক কোনো মনোবল ছিল না। আমি প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায় ট্রাস্টের তহবিলের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলাম এমন কোনো বক্তব্য রাষ্ট্রপক্ষের কোনো সাক্ষী দেয়নি। আমার বিরুদ্ধে দুটি অনুসন্ধান করা হয়। অনুসন্ধানে আপনি (বিচারক) দেখতে পাবেন এই দুটি রিপোর্ট দুই ব্যক্তির হলেও বাক্য ও শব্দচয়ন অভিন্ন। সরকারের আজ্ঞাবহ হয়ে তাদের নির্দেশিত মতে আমার বিরুদ্ধে অনুসন্ধান ও তদন্ত করে মিথ্যা প্রতিবেদন দিয়েছেন।
বিএনপি চেয়ারপারসন বলেন, ট্রাস্টের সঙ্গে আমার কোনো সম্পৃক্ততা নেই, তা সত্ত্বেও দুদক কর্মকর্তা আমার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছেন। টাকার উৎস সম্পর্কে কোনো তথ্যপ্রাপ্তি ছাড়াই এজাহার রুজু করেছেন। আমাকে ও আমার রাজনৈতিক দলকে সামাজিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতে তিনি মিথ্যা তথ্য এজাহারে উল্লেখ করেছেন, বক্তব্য দিয়েছেন। আর তার এই মিথ্যা বক্তব্যের সূত্র ধরে একটি রাজনৈতিক দল আমার ভাবমূর্তি ক্ষুণœ করে চলেছে।
খালেদা জিয়া বলেন, মামলার বিচার্য বিষয় প্রধানমন্ত্রীর এতিম তহবিল সংক্রান্ত কোনো মূল নথি দুদক কর্তৃক মৌখিক এবং লিখিতভাবে চাওয়ার পরও এইরূপ নথি উপস্থাপন করা হয়নি। প্রধানমন্ত্রীর এতিম তহবিলে বিদেশি অনুদান সোনালী ব্যাংক রমনা কর্পোরেট শাখায় এসেছে, এরূপ দাবির সমর্থনে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক শাখা থেকে মূল ডি.ডি. সোনালী ব্যাংক দিতে পারেনি। এ সংক্রান্ত বিষয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক শাখা থেকে একটি অ্যাকাউন্ট খোলার আবেদন বিজ্ঞ আদালতে দাখিল করা হয়েছে এবং তা প্রধানমন্ত্রীর দফতরের তদানিন্তন সচিব ড. কামাল সিদ্দিকী কর্তৃক খোলা হয়েছে বলে দাবি করা হয়। উক্ত অ্যাকাউন্ট সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কর্মকর্তা কোনো লেজার বা অন্য কোনো ডকুমেন্ট দ্বারা কোনো সাক্ষ্য প্রদান করেন নাই।
সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী বলেন, অ্যাকাউন্ট ওপেনিং ফরমের কোথাও প্রধানমন্ত্রীর দফতরের কোনো দাফতরিক আদেশ অথবা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আমার অনুমোদন গ্রহণ করা হয়েছেÑ এরূপ কোনো দালিলিক সাক্ষ্য কেউ উপস্থাপন করেননি। এই অ্যাকাউন্ট ওপেনিং আবেদনে কোথাও আমার কোনো সই-স্বাক্ষর নেই। সাক্ষীগণের সাক্ষ্যের স্বীকৃত মতে তদানিন্তন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ.এস.এম. মোস্তাফিজুর রহমান নিজ উদ্যোগে এই অনুদানের অর্থ আনার ব্যবস্থা করেন। পিডব্লিউ-৩১ ও পিডব্লিউ-৩২ উভয়ে তাদের সাক্ষ্যে তদানিন্তন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমানের নাম মূল অনুদান আনার বিষয় বিভিন্ন তথ্যাবলি সংগ্রহের মাধ্যমে স্বীকার করেন। সোনালী ব্যাংক সংশ্লিষ্ট শাখার কর্মকর্তা অ্যাকাউন্ট খোলা সম্পর্কিত অভিযাচনপত্রের পরও কোনোরূপ তথ্য সরবরাহ করতে পারেন নাই। এক্সিবিট-৪৮-এ এই সাক্ষ্য আছে।
বিএনপির চেয়ারপারসন বলেন, দুটি অনুসন্ধান রিপোর্ট পাশাপাশি পর্যালোচনা করলে আপনি দেখতে পাবেন অনুসন্ধান রিপোর্ট দুটি ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তি কর্তৃক দাখিল হওয়া সত্ত্বেও দুটি রিপোর্টের ভাষা, বাক্য ও শব্দ চয়ন এক ও অভিন্ন। ১১ জুনের রিপোর্টে সোনালী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপক মো. আজিজুল ইসলামকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় মর্মে একটি বাক্য রয়েছে। ২৫ জুনের রিপোর্টেও সোনালী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপক আজিজুল ইসলামকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় মর্মে অনুরূপ একটি বাক্য রয়েছে। দুটি রিপোর্টের দুটি বাক্যেই ‘আজিজুল’ নামটি কেটে একই হাতে আজিজুলের উপরে ‘মফিজুল’ নামটি বসানো হয়েছে। দুজন অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা কর্তৃক দুটি ভিন্ন ভিন্ন সময়ে দুটি ভিন্ন ভিন্ন রিপোর্ট দাখিল করা হলে একই হাতের লেখায় একই নাম অনুরূপভাবে কাটাকাটি কী করে সম্ভব তা আপনি বিবেচনা করে দেখবেন। এতে স্পষ্ট বুঝা যায় যে, হারুন-অর-রশীদ কোনো নিরপেক্ষ অনুসন্ধান না করে একটি মহল কর্তৃক নির্দেশিত হয়ে পূর্বের রিপোর্ট অর্থাৎ নুর আহাম্মদ কর্তৃক ১১ জুনের রিপোর্টটিই হুবহু প্রিন্ট করে রিপোর্টের শেষাংশে শুধু আমার নামটি সংযোজন করেছেন। দুর্নীতি দমন কমিশনের কর্মকর্তা সাক্ষী হারুন-অর-রশীদ নিরপেক্ষ অনুসন্ধান না করে নিজেই দুর্নীতির আশ্রয় গ্রহণ করে একটি অসত্য রিপোর্ট দাখিল করে আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দায়েরের প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেন। ফলে এই সাক্ষীর সাক্ষ্য আইনের দৃষ্টিতে অগ্রহণযোগ্য। সম্পাদনা : শাহানুজ্জামান টিটু