মহানবীর ‘বিদায় হজের ভাষণ’
মুফতি আরাফাত হুসাইন
১০ হিজরির ৯ জিলহজ। জুমাবার। আরাফার দিন। আরাফার মরু উদ্যানে প্রায় সোয়া লাখ জনতার সমাবেশ। সূর্য খানিক পশ্চিমাকাশে হেলে পড়েছে। শেষ বিকেলে মুক্তিকামি জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দিলেন নবিজি হজরত মুহাম্মদ সা.। ইসলামের ইতিহাসে এ ভাষণ ‘বিদায় হজের ভাষণ’ নামে পরিচিত। সৃষ্টির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আগত-বিগত পৃথিবীর সব ভাষণের মধ্যে এ ভাষণ শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদায় বিভূষিত। আরশে আজিমে রাব্বুল আলামিন কর্তৃক এ ভাষণের শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকৃত। এ ভাষণের শ্রেষ্ঠত্বের স্বীকৃতি দিয়ে আল্লাহ বলেন, ‘আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পরিপূর্ণ করে দিলাম, তোমাদের প্রতি আমার অবদান পূর্ণ করে দিলাম এবং ইসলামকে তোমাদের ধর্ম হিসেবে মনোনীত করলাম’। (সুরা মায়িদা-৩)
নবিজি সা. এর সে দিনের বিদায়ী ভাষণে ছিল সাম্যের ভিত্তিতে বর্ণ ও বৈষম্যহীন সমাজ ব্যবস্থার আহ্বাণ। নবিজি সা. ঘোষনা করে বলেন, ‘হে মানবম-লী, তোমাদের প্রভূ একক। তোমাদের আদি পিতা একজন। প্রত্যেকেই আদমের সন্তান। আদম মাটির তৈরি। আল্লাহ তায়ালা পারস্পরিক পরিচিতির সুবিধার্থে বিভিন্ন সমাজ ও গোত্রে তোমাদের বিভক্ত করেছেন। সুতরাং আরব-অনারবের শ্রেষ্ঠত্বে কোনো বৈষম্য নেই, শ্বেতাঙ্গ-কৃষ্ণাঙ্গের শ্রেষ্ঠত্ব আর বৈশিষ্টেও নেই কোনো বৈষম্য। বরং শ্রেষ্ঠত্ব, বৈশিষ্ট্য আর মর্যাদার ভিত্তি হলো তাকওয়া তথা আল্লাহর আনুগত্যে।’ নবিজি সা. তার ঐতিহাসিক ভাষণে নিশ্চিত করেছিলেন প্রত্যেক নাগরিকের জান মালের চূড়ান্ত নিরাপত্তা বিধান আর অবৈধ ও নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন অভিশপ্ত সন্ত্রাস হত্যা ও নৈরাজ্যকে। বলেছেন ‘হে লোক সকল, তোমাদের রক্ত, সম্মান ও সম্পদ পরস্পরের জন্য চিরতরে হারাম করা হলো যেমন আজকের এই দিন, এই মাস ও এই শহরে রক্তপাত করা হারাম বা নিষিদ্ধ।’ নবিজি সা. এর শ্রেষ্ঠ ভাষণে ছিল ন্যায় ও ইনসাফভিত্তিক বিচারব্যবস্থার কার্যকর পদক্ষেপ। ক্ষমতার দৌরাত্ব, ঘুষের বিনিময়ে বা স্বজনপ্রীতি করে প্রকৃত দোষী পার পাওয়ার দুয়ার করেছেন চির রুদ্ধ। নবিজি সা. বলেন, ‘শুনে রাখো, অপরাধের দায়ভার অপরাধির উপরই বর্তাবে। পিতা তাঁর পুত্রের বা পুত্র তার পিতার অপরাধের জন্য দায়ী নয়’। সাবধান তোমরা জুলুম করবে না! সাবধান তোমরা জুলুম করবে না!! সাবধান তোমরা জুলুম করবে না!!!ম নবিজি সা. এর বিদায়ী ভাষণে ছিল নারী অধিকার ও নারী মুক্তির বিপ্লবী ঘোষণা। বঞ্চিত নির্যাতিত নারী পেয়েছে তার বাঁচার অধিকার। সমাসিন হয়েছে মর্যাদার সুউচ্চ শিখরে। নবিজি সা. বলেন, ‘হে বিশ্ববাসি, নারীদের প্রতি নির্দয় আচরণ পরিহার করবে, আল্লাহকে ভয় করো। নিশ্চয়ই তোমরা তাদের আল্লাহর জামিনে গ্রহণ করেছ এবং তাঁরই কালেমার মাধ্যমে তাদের সঙ্গে তোমাদের দাম্পত্য সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। জেনে রেখো, তাদের ওপর তোমাদের যেমন অধিকার রয়েছে, তোমাদের উপর ও তাদের অধিকার রয়েছে। তাদের সার্বিক কল্যাণের বিষয়ে তোমরা আমার অন্তিম উপদেশ গ্রহণ করো’।
নবিজি সা. এর ভাষণে দৃঢ় কন্ঠে উচ্চারিত হয়েছিল ইতিহাসের শ্রেষ্ঠতম শ্রমনীতি। যে নীতি গ্রহণে মালিক ও শ্রমিকের মুখে ফুটবে আনন্দের হাসি। নবিজি সা. বলেন, ‘হে মানুষেরা, তোমাদের অধীনস্তদের ব্যাপারে সতর্ক হও। তারা তোমাদের ভাই। তোমরা নিজেরা যা খাও তাদের তা খাওয়াবে। তোমরা নিজেরা যা পরিধান করো তাদের তা পরিধান করাবে। তাদের ওপর সাধ্যাতিরিক্ত শ্রমের বোঝা চাপিয়ে দেবে না। যদি কোনো কারণে চাপিয়ে দিতে হয়, তবে তুমিও তাতে অংশীদার হও’।
নবিজি সা. এর উদার ভাষণে ছিল ভ্রাতৃত্ববোধ ও ঐক্যের আহ্বান। নবিজি সা. ঘোষণা করে বলেন, ‘প্রিয় মুসলিম উম্মাহ, শুনে রাখো, মুসলমান পরস্পর ভাই ভাই। আমার অবর্তমানে পরস্পর মারামারি ও হত্যাযজ্ঞে লিপ্ত হয়ে কাফির হয়ে যেও না। মনে রেখো! শয়তান এ বিষয়ে নিরাশ হয়ে গেছে, যারা নামাজ আদায় করে তারা শয়তানের পূজারি হবে না। তবে হ্যাঁ, সে তোমাদের বিভিন্ন ভাবে উসকানি দেবে’। নবিজি সা. সকল সামাজিক প্রথা আর বর্বরতা নিষিদ্ধ করে ঘোষণা করেছেন, ‘শুনে রাখো, অন্ধকার ও বর্বর যুগের সব প্রথা আজ আমার পায়ের নিচে পদদলিত। জাহেলি যুগের রক্তের দাবিও আজ থেকে রহিত করা হল’।
নবিজি সা. মানবতার মুক্তির ভাষণে পুঁজিবাদী সুদভিত্তিক অর্থব্যবস্থার মূলোৎপাটন করে যাকাতভিত্তিক অর্থব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার ত্যাজদ্বীপ্ত ঘোষনা করে বলেন, ‘জাহেলি যুগের সুদব্যবস্থা রহিত করা হলো। সর্বপ্রথম আমি আমার চাচা হজরত আব্বাসের সুদ মাফ করে দিলাম, আর সেই সঙ্গে গোটা সুদব্যবস্থা আজ থেকে রহিত করা হলো। সামাজিক শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নবিজি সা. বলেন, ‘ঋণ অবশ্যই আদায় করতে হবে। নবিজি সা. বিদায়ী হজের বিদায়ী ভাষণে জাতির উদ্দেশ্যে বলেন, ‘হে লোক সকল শুনে রেখ, ‘সাবধান! ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি ও সংঘাতের পথ বেছে নিও না। এতে তোমাদের ধ্বংস অনিবার্য হয়ে পড়বে
আর আমি তোমাদের কাছে দুটো জিনিস রেখে যাচ্ছি। যত দিন তোমরা এ দুটো জিনিস আঁকড়ে থাকবে, তোমরা পথভ্রষ্ট হবে না। সে দুটি বস্তু হলো- আল্লাহর কিতাব ও সুন্নাতে রাসুল। তোমরা যারা আজ এখানে উপস্থিত আছ, অনুপস্থিতদের কাছে আমার এই আদেশ-উপদেশগুলো পৌঁছে দিবে। অশান্ত পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে ফিরে দেখতে হবে ‘ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ ভাষণ প্রিয় নবিজির বিদায়ী ভাষণ’