এমন বৈকল্যের শহরে তাকে ভীষণ প্রয়োজন আমাদের
প্রতীক ইজাজ
কিছু কিছু মৃত্যু সত্যিই কষ্টের। কিছু মৃত্যুর ক্ষত বয়ে বেড়াতে হয় বহুদিন। কিছু মৃত্যু নিতান্তই ব্যক্তিগত। কিছু সর্বজনীন, সবার জন্যই বেদনার, কষ্টের। কিছু মৃত্যু দৃশ্যের অন্তরালে আরও স্পষ্ট করে রাখে চলে যাওয়া মানুষকে। ছবির মতো ভাসে। আনিসুল হকের মৃত্যু এর সবগুলোকেই স্পর্শ করেছে। আনিসুল হক তেমনই একজন প্রিয় মানুষ আমাদের। উজ্জ্বল, আলোময়। তার মৃত্যুর পর এই শহরে যে শোকের ছায়া পড়েছে, মানুষ যতটা শোকাচ্ছন্ন হয়েছে, তা নিঃসন্দেহে একজন সর্বজনপ্রিয় মানুষের কথাই বলে। ব্যক্তিগত সফরে সপরিবারে যুক্তরাজ্য গিয়েছিলেন। সফর শেষে ফিরে আসার কথা ছিল। আসেননি। অসুস্থ হয়ে ভর্তি হন হাসপাতালে। আশায় বুক বেঁধেছিল শহর। আবার ফিরে আসবেন তিনিÑ তারই শহরে, এই নাগরিক বৃত্তে। উৎকন্ঠায় সময় কেটেছে আমাদের। শারীরিক অবস্থা নিয়ে সত্য-মিথ্যা খবর রটেছে। উদ্বেগ বেড়েছে। বিমর্ষ শহর ও মানুষ তার সুস্থতায় প্রার্থনা করেছে, আকুল আকুতি জানিয়েছে। কোনো কিছুই কাজে আসেনি। সবাইকে অপেক্ষায় রেখে ৩০ নভেম্বর বৃহস্পতিবার সত্যিই চলে গেলেন তিনি না ফেরার দেশে। মাঝরাতে যখন সে খবর পৌঁছুল, কেঁদে উঠল শহর, শহরের মানুষ। শোকাচ্ছন্ন হয়ে পড়ল গণমাধ্যম ও ফেসবুক। এই প্রথম এই শহর বুঝল, শুধু নগরপিতাই নন; নানা মাধ্যমে দীর্ঘ পথপরিক্রমায় আক্ষরিক অর্থেই তিনি ‘আমি’ থেকে ‘আমাদের’ হয়ে উঠেছিলেন। কেবল তাকেই বলা যায়Ñ চলেই গেলেন ‘আমাদের’ আনিসুল হক। কিভাবে এই ‘আমি’ থেকে ‘আমাদের’ হয়ে উঠলেন তিনি, সে গল্প বিস্ময়ের, অনুপ্রেরণার, সবার জানা। চোখের সামনেই সে গল্পের বুনন। দিন দিন একটু একটু করে ‘আমি’ শব্দটি ‘আমাদের’ হয়ে উঠেছে। আমরা কেউ বুঝেছি, কেউ বুঝিনি। মৃত্যুর পর বুঝলাম। সবার চোখের জল আরও বেশি দীপ্তময় করে তুলল শব্দটি। টেলিভিশন, ব্যবসা-উদ্যোক্ততা, রাজনীতিÑ তিন মাধ্যমেই সফল মানুষ ছিলেন আনিসুল হক, উজ্জ্বল মানুষ, শীর্ষ মানুষ। মেধা, সৃজনশীলতা ছিল তার। ব্যতিক্রমী প্রয়াস ছিল। পরিশ্রম করেছেন। স্পষ্ট করে কথা বলতেন। ভয় পেতেন না। নির্লোভ ছিলেন, নির্মোহ। মানুষ, কল্যাণ, সর্বজনের জন্য ভাবতেন। ক্ষমতা, শক্তি ছিল। ব্যক্তি, পারিবারিক, দলীয় বা মুখচেনাতে প্রয়োগ করেননি। সর্বজনের শক্তি সর্বজনের কাজেই লাগিয়েছেন। বুক চিতিয়ে মানুষের জন্য দাঁড়িয়েছেন। সফল হয়েছেন। যাত্রা শুরু হয়েছিল ব্যবসায়ী হিসেবে। মাঝখানে টেলিভিশন উপস্থাপক। মাত্র দুই বছর আগে যুক্ত হলেন রাজনীতিতে, মেয়র নির্বাচনের মধ্য দিয়ে। সেই একইভাবে, সৃজনশীলতায়, মেধা-মননে চমক ফেললেন চারপাশে। নানা পোস্টারে ঢেকে থাকা এই শহর চমকে উঠল এক অভিনব পোস্টার-ব্যানারেÑ ‘সমস্যা চিহ্নিত, এবার সমাধান যাত্রা’। ২০১৫ সালে মেয়র নির্বাচিত হলেন। মাত্র দুই বছরেই ‘সফলতার ফুল’ তাকে ‘আমাদের’করে তুলল। কিন্তু প্রতিশ্রুত স্বপ্নের সেই পুরোটা পাল্টানো হলো না তার ঢাকাকে। বড় অসময়ে চলে গেলেন।
একটি মানবিক শহর চেয়েছিলেন। সর্ব মানুষের বাসযোগ্য সাম্যের শহর। মানবিক নাগরিক চেয়েছিলেন। তাই প্রথাগত রাজনীতির পথে না গিয়ে মানুষের সেবায় ‘নগরপিতা’হলেন। সততা-তারুণ্য, সাহস-উদ্দীপনা, নির্লোভ-নির্মোহ; এই দর্শনই তাকে ‘সবার’ করে তুলেছিল। মানুষের কাছে থেকেছেন। তাদের কথা শুনেছেন। উন্নয়ন ও স্বপ্নের পথে হেঁটেছেন সবাইকে নিয়ে। পেশীশক্তির রাজনীতিতে পা রাখেননি। ক্ষমতার রাজনীতি তাকে ছুঁতে পারেনি। বরং চড়ে বসেছেন উল্টো রথে। নির্মোহ নির্লোভ দর্শন দিয়ে সুন্দর সাম্যের সর্বজনীন সংস্কৃতি গড়েছেন। তার চলে যাওয়ায় তাই কাঁদছে মানুষ, সর্বজন। এমন কান্না এই যান্ত্রিক সময়ে বড় দুষ্প্রাপ্য। অথচ এমন বৈকল্যের শহরে তাকে ভীষণ প্রয়োজন আমাদের। এত দুর্ভোগে জঞ্জালে আর ভালো লাগে না।
লেখক: সাংবাদিক, কবি ও সংস্কৃতিকর্মী
সম্পাদনা: আশিক রহমান