কল্পনা নয়, বাস্তবেই যদি ইতিহাস খালেদা জিয়ার ওপর প্রতিশোধ নেয়?
১৯৮৯ এপ্রিলের কথা। কাজী জাফর আহমেদ তখন প্রধানমন্ত্রী। হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ জমানা। উত্তপ্ত রাজনীতির মাঠ। একটি দৈনিকে কাজ করি। তার সুদীর্ঘ সাক্ষাৎকারের জন্য দুদিন দু’দফায় কাজ করতে হয়েছিল। কুমিল্লার মানুষ রওশন আরা মান্নান এমপির সহযোগিতায় এটি সহজ হয়। যাই হোক, হেয়ার রোডে কাজী জাফরের সরকারি বাড়ির দোতলায় আমি। রাত গভীর হচ্ছে। আমাকে সময় দিয়েছেন রাত ১১টায়। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী ব্যস্ত অতিথি নিয়ে। চীনা রাষ্ট্রদূতের সিডিউল নির্ধারিত সময়ে শেষ হলেও কাজী জাফর কক্ষ থেকে বের হচ্ছিলেন না। আমার অপেক্ষা করা সার। তার বিষয়ে হোম ওয়ার্ক করেছি আগের রাত। লিখে রাখা প্রশ্ন চোখ বোলাচ্ছি। বারবার ওয়েটার এসে বলছে, ‘স্যার, চা বা কফি দেব আরেক কাপ?’ গভীর রাতে চা-কফি কতবার খাওয়া যায়? উসখুস্ করছি। হঠাৎ এলেন তিনি। এসেই সামনের চেয়ারে বসতে বসতে
বিলম্বের জন্য ক্ষমা চেয়ে কাজী জাফর বললেন, ‘ভাইরে, বাস্তবতা অস্বীকার করা যায় না, এটি মেনে নিতেই হয়। ইতিহাস হয়তো অনেক কিছুই ক্ষমা করে না, কারণ কোনো ইতিহাসই মুছে ফেলা যায় না।’ কে না জানে কাজী জাফর বিতর্কিত রাজনীতিক। কিন্তু একদার ডাকসাইটে শ্রমিক নেতা কীভাবে যেন ‘পাওয়ার পলিটিক্সের’ হাতিয়ার হয়ে গেলেন। মন্ত্রী, উপ-প্রধানমন্ত্রী এরপর প্রধানমন্ত্রী!
আসলে আমরা অনেকেই ভুল করেও সত্যকে স্বীকার করি না, মানতে চাই না। ফলে বাংলাদেশে যা হওয়ার নয় তাই হয়। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে প্রাণ দিতে হয়। যার নেতৃত্বে এ দেশের জন্ম হয়েছিল। যার ডাকে হয় মুক্তিযুদ্ধ। আর ’৭৫- এর পর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ বন্ধ করা হয়। এটাই সম্ভবত ইতিহাস যে, ১৮ নভেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নাগরিক সমাবেশে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের ইউনেস্কোর স্বীকৃতি উদযাপন করি আমরাই। এ কারণেই বলব, বাস্তবতা মানতে হয়. সেটা পারিবারিক হোক আর সামাজিক হোক কিংবা রাজনৈতিক। পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহের কথা যদি বলি! বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরতো কতবার ক্যু, সেনা হত্যা, বিচারের নামে প্রহসন হয়েছে। কিন্তু এবার হয়েছে বিচার, এটা সরকারের জন্য অত্যন্ত কঠিন ও জটিল ছিল। পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহ, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মামলাসহ কয়েকটি ঘটনা বর্তমান সরকারের জন্য বিরাট চ্যালেঞ্জ ছিল। নানা কারণেই এগুলো অতি গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর। এরই মধ্যে ২৮ নভেম্বর মর্মান্তিক পিলখানা হত্যা মামলার হাইকোর্টের রায় ঘোষিত হয়েছে। শুধু নিহতদের স্বজনরাই নন, গোটা দেশবাসী এর অপেক্ষায় ছিল। ২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি পিলখানার বিডিআর সদর দফতরে (বর্তমান বিজিবি সদর দফতর) সংঘটিত হত্যাকা- যেমন ছিল ইতিহাসের নজিরবিহীন এক ঘটনা, তেমনি এ হত্যা মামলার রায়ও নানা দিক থেকে নজির স্থাপন করেছে। রায়ে ১৩৯ জনের মৃত্যুদ- বহাল রেখেছেন হাইকোর্ট। ১৮৫ জনকে দেওয়া হয়েছে যাবজ্জীবন কারাদ-। ২০০ জনকে বিভিন মেয়াদে কারাদ- দিয়েছেন হাইকোর্ট। এক মামলায় এতজনকে মৃত্যুদ- ও অন্যান্য সাজা দেওয়ার নজির শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বের কোথাও নেই। এদিক থেকে দেখলে এবং ঘটনার ব্যাপকতা ও নৃশংসতাকে আমলে নিলে এটি একটি ঐতিহাসিক রায় হিসেবে বিবেচিত হবে নিঃসন্দেহে। উল্লেখ্য, পিলখানার রক্তক্ষয়ী ঘটনায় ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জন নিহত হন। স্বভাবতই এ ঘটনা দেশব্যাপী ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। অপরটি ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা। এরও বিচার কার্যক্রম প্রায় শেষের দিকে। তাই সরকারের সামনে এখন একটিমাত্র ইস্যু একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা না করা নিয়ে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে মধ্যে মূলত প্রধান দুটি ইস্যু নিয়েই বিত-া চলছে। সেনাবাহিনীকে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দিয়ে নির্বাচনে সেনা মোতায়েন আর তত্ত্বাবধায়ক বা নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের দাবি তুলছে বিএনপি। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ নির্বাচনে সেনা মোতায়েনের বিরোধিতা করছে না তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারের অধীনেই নির্বাচন করতে চাইছে। দলটি মনে করে, তাদের সরকার নির্বাচনের আগে আরো কঠোর হবে। বিশেষ করে খালেদা জিয়ার সাজার রায় হয়ে যাওয়ার পরপরই।
বর্তমান নির্বাচন আইন অনুসারে কারও ন্যূনতম দুই বছরের সাজা হলে সাজার মেয়াদ শেষ হওয়ার পর পাঁচ বছর তিনি নির্বাচনে অযোগ্য হবেন। ইতোমধ্যে খালেদা জিয়ার ছেলে ও বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান মুদ্রাপাচার মামলায় ২০১৬ সালে হাইকোর্ট সাত বছরের কারাদ- ও ২০ কোটি টাকা অর্থ দ- দেন। তিনি এ মামলার বিরুদ্ধে আপিল করেননি তাই আইনের চোখে তারেক রহমান পলাতক। খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে পাঁচটি মামলা রয়েছে। সবকটি মামলা দুর্নীতির। সবকটির বাদি (দুদক) দুর্নীতি দমন কমিশন। পাঁচটি মামলাই বিচারাধীন। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে দুর্নীতি মামলায় তাদের হাত নেই, এগুলো ওয়ান ইলেভেনের সরকার আমলে করা। এর সঙ্গে সরকারের সম্পর্ক নেই, আদালতের বিষয় এটি। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছেÑ জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট ও চ্যারিটেবল মামলায় বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান সাজা এড়াতে পারবেন না বলেই প্রচারিত হচ্ছে। যদি তা-ই হয় তাহলে অতি কঠিন চাপে পড়বে বিএনপি আর কাক্সিক্ষত সুযোগটি কোনোভাবেই হাতছাড়া করবে না আওয়ামী লীগ। এদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে প্রধান দুই দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। দুই জোটও তারা। খালেদা জিয়ার সাজার ব্যাপারে আতঙ্কে এখন বিএনপি। অপরদিকে আওয়ামী লীগও যে দুশ্চিন্তামুক্ত, তা নয়। কারণ, দশম সংসদ নির্বাচনে কোনো প্রতিপক্ষ না থাকায় যতটা সহজ হয়েছেÑ বাস্তবতা কিন্তু মোটেই সহজ নয়। তাই দলটি যেকোনো উপায়ে নির্বাচনে বিজয় নিশ্চিত করতে চায়। অনেকের মতে, দশম নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে বিএনপি যে ভুলটি করেছে এর চেয়ে বড় ভুল হবে যদি সামনের একাদশ সংসদ নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ না করে। এ কারণে মুখে যত কথাই বলুক বিএনপি নির্বাচনে যাবেই। আগামী নির্বাচন ঠেকানোর ক্ষমতা কী বিএনপির আছে? এ প্রশ্নটি হরহামেশা শোনা যায়। সেই সাংগঠনিক শক্তিও নেই এখন দলটির। এছাড়া সরকারও তখন কঠোর হবে। বিএনপির সিনিয়র-জুনিয়র নেতাদের তালিকা গোয়েন্দা-পুলিশের হাতে। সম্প্রতি স্বয়ং খালেদা জিয়া আশঙ্কা করে বলেছেন, আমাকে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণার নীলনকশা করা হয়েছে। আর চার ডিসেম্বর এক অনুষ্ঠানে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন, ‘বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির ঘটনা সরকারের ‘বৃহত্তর পরিকল্পনা’র অংশ।’
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, কলামিস্ট ও গল্পকার
সম্পাদনা : আশিক রহমান