সুরা নিসার আয়াত দিয়ে বক্তব্য শেষ করলেন খালেদা জিয়া আমি সম্পূর্ণ নির্দোষ, মামলায় বেকসুর খালাস পাওয়ার যোগ্য
শাহানুজ্জামান টিটু ও কিরণ সেখ : সূরা নিসার ১৩৫ নম্বর আয়াত তরজমার মধ্য দিয়ে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় আত্মপক্ষ সমর্থনে নিজের বক্তব্য শেষ করেছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। তিনি বলেছেন, আমি এ মামলায় সম্পূর্ণ নির্দোষ। মামলায় খালাস পাওয়ার যোগ্য। এরপর তিনি আয়াতের অর্থ পড়ে শোনানÑ ‘হে ইমানদারগণ, তোমরা ন্যায়ের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকো; আল্লাহর ওয়াস্তে ন্যায়সঙ্গত সাক্ষ্যদান কর, তাতে তোমাদের নিজের বা পিতা-মাতার অথবা নিকটবর্তী আত্মীয়-স্বজনের যদি ক্ষতি হয় তবুও। কেউ যদি ধনী কিংবা দরিদ্র হয়, তবে আল্লাহ তাদের শুভাকাক্সক্ষী তোমাদের চাইতে বেশি। অতএব, তোমরা বিচার করতে গিয়ে রিপুর কামনা-বাসনার অনুসরণ কোরো না। আর যদি তোমরা ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে কথা বলো কিংবা পাশ কাটিয়ে যাও, তবে আল্লাহ তোমাদের যাবতীয় কাজ-কর্ম সম্পর্কেই অবগত।’
গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর বকশী বাজারে বিশেষ জজ আদালতে ৫-এ হাজির হয়ে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলার আত্মপক্ষ সমর্থনের বক্তব্য উপস্থাপনের সময় খালেদা জিয়া এ কথা বলেন। বেলা সোয়া ১১টা থেকে ২টা ২৫ মিনিট পর্যন্ত খালেদা জিয়া আত্মপক্ষ সমর্থন করে তার বক্তব্য উপস্থাপন করেন। পরে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় ১৯, ২০ ও ২১ ডিসেম্বর যুক্তিতর্কের শুনানির জন্য পরবর্তী তারিখ ধার্য করেন আদালত। জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায়ও একই দিনে সাফাই সাক্ষীর জন্য দিন ধার্য রয়েছে।
গত বৃহস্পতিবার আদালতে খালেদা জিয়া হাজির না হওয়ায় জামিন বাতিল করে তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছিলেন আদালত। আদালতে হাজির হয়ে শুরুতেই জামিন চাইলে আদালত পৃথক দুই মামলায় তা মঞ্জুর করেন।
খালেদা জিয়ার আত্মপক্ষ সমর্থনে বক্তব্য শুরুর আগে আদালতের বিচারক আখতারুজ্জামান বলেন, এ পর্যন্ত আপনার বক্তব্যের ১৩৪ পৃষ্ঠা লিখেছি। আপনার যা বলার আজকেই বলতে হবে। যদি আজকে আপনি সারাদিন বলেন, আমি সারাদিন লিখবো। এরপরও যদি আর কিছু বলার থাকে সেটা লিখিত দিতে হবে।
আদালতের কাছে ন্যায় বিচার দাবি করে খালেদা জিয়া বলেন, আমার পারিবারিক বাসস্থান, ৬ মইনুল রোড, এখানে আমার পরিবারের সকলেই থাকতেন। এটা প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন নয়। আমি আমার পদে থাকার সময় আমার অধীনস্থ কারো মাধ্যমে আমার পদের প্রভাব খাটাইনি। কাউকে কোনো অন্যায় আদেশ প্রদান করিনি। কারো কোনো অর্থের দ্বারা ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হইনি কিংবা কাউকে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান করিনি।
আত্মপক্ষ সর্মথনে দেওয়া বক্তব্যে খালেদা জিয়া বলেন, প্রধানমন্ত্রীর এতিম তহবিল নামে কোনোদিন কোনো তহবিল ছিল না এবং এটা অস্তিত্ববিহীন। এর কোনো একাউন্টের প্রমাণপত্র, কোনো মূল নথিপত্র, কোনো নোটশিট উপস্থাপিত হয়নি। কতগুলো সই-স্বাক্ষরবিহীন ঘষামাজা ফাইল নম্বর উল্লেখ করে কিছু রেকর্ড প্রস্তুত করে দুদক কর্মকর্তা এই মামলায় আমাকে হয়রানিমূলকভাবে জড়িত করার ব্যর্থ চেষ্টা করেছেন। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের হিসাব বিবরণী বা এই সংক্রান্ত কোনো কর্মকা-ের সঙ্গে আমি খালেদা জিয়ার কিংবা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে খালেদা জিয়ার কোনো সম্পর্ক নেই কিংবা কখনো ছিল না।
এই মামলার পক্ষে সাক্ষীদের দেওয়া বক্তব্য খ-ন করে সপ্তম দিনে খালেদা জিয়া আদালতে বক্তব্য তুলে ধরেন। এসময় বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর সমালোচনা করে তিনি বলেন, আমাদের রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী পক্ষ, বিশেষ করে বর্তমান সরকারের প্রধানমন্ত্রী এবং তার মন্ত্রিপরিষদের কতিপয় সদস্য প্রায়শই আমাকে জড়িয়ে জনসমক্ষে মিথ্যা বক্তব্য প্রচার করেন। পিডব্লিউ ১ হারুন-অর-রশীদের জবানবন্দিতে আমার বিরুদ্ধে যেসব মনগড়া ও মিথ্যা বক্তব্যে দিয়েছেন তার সঙ্গে সেই সব অপপ্রচারণার একটি সামঞ্জস্য পাওয়া যায় যা থেকে আপনি সহজেই অনুধাবন করতে পারবেন যে, হারুন-অর-রশীদকে একটি বিশেষ উদ্দেশ্যে এই মামলার অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা, মামলার বাদী এবং তাকেই মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা হিসেবে আমার বিরুদ্ধে কাজে লাগানো হয়েছে।
সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, আমি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট গঠন করিনি। কাজেই আমার সৎ কিংবা অসৎ কোনো উদ্দেশ্য থাকার সুযোগ নেই। আমি এই ট্রাস্টের তহবিল সংগ্রহ, বণ্টন অথবা কোনো রকম ব্যাংকিং লেনদেনের সঙ্গে কোনোভাবে জড়িত ছিলাম না। কাজেই এর মাধ্যমে নিজে লাভবান হওয়ার বা অন্য কাউকে লাভবান করারও কোনো প্রশ্ন উঠতে পারে না।
খালেদা জিয়া বলেন, বিএনপি সরকার একজন বিচারপতির নেতৃত্বে একটি স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে দুর্নীতি দমন কমিশন আইন-২০০৪ প্রণয়ন করে। দুর্নীতি দমন কমিশন আইন-২০০৪-এর ৩(২) ধারার বিধানমতে কমিশন হবে একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ কমিশন। অথচ এই মামলায় কমিশনের কর্মকর্তা হিসেবে সাক্ষী হারুন-অর-রশিদ কমিশনের সেই স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতার প্রমাণ দিতে পারেননি। এই সাক্ষী হারুন-অর রশিদকে কমিশনের সেটআপে অন্তর্ভুক্ত না করায় পরবর্তীতে আমার বিরুদ্ধে মামলা করা এবং সাক্ষী দেওয়ার জন্য তাকে আবার কমিশনে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। তিনি দুর্নীতি দমন কমিশন আইনের ৩(২) ধারায় উল্লিখিত নিরপেক্ষতার বিধান লঙ্ঘন করে কোনোরূপ দালিলিক প্রমাণ ছাড়া মাত্র ১৫ দিনের ব্যবধানে আমার বিরুদ্ধে একটি হয়রানিমূলক ও মিথ্যা রিপোর্ট দাখিল করেন এবং এরই ধারাবাহিকতায় তিনি আদালতেও কোনো তথ্য-প্রমাণ বা দালিলিক প্রমাণাদি ছাড়া আমার বিরুদ্ধে বিভিন্ন মিথ্যা অভিযোগ করেছেন।
তিনি বলেন, চাকরিতে পদোন্নতি ও ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হওয়ার অসৎ উদ্দেশ্যে তিনি আমার প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক মহলের ইচ্ছা ও নির্দেশ অনুযায়ীই যে এসব করেছেন তা স্পষ্টই প্রতীয়মান হয়। আমি এই মিথ্যা অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করছি এবং আপনার আদালতে ন্যায়বিচার প্রার্থনা করছি।
প্রসঙ্গত, ২ কোটি ১০ লাখ ৭১ হাজার ৬৭১ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে করা জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় আসামি খালেদা জিয়া, তার বড় ছেলে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ ৬ জন। তারেক রহমানের বিরুদ্ধে এরইমধ্যে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছেন আদালত। ৩ কোটি ১৫ লাখ ৪৩ হাজার টাকা আত্মসাতের অভিযোগে করা জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় আসামি খালেদা জিয়াসহ ৪ জন। সম্পাদনা : হাসিবুল ফারুক চৌধুরী