স্বেচ্ছাসেবক দিবস ও দানের বীরত্ব
কাকন রেজা
৫ ডিসেম্বর ছিল সম্ভবত ‘স্বেচ্ছাসেবক দিবস’। এক প্রিয়জনের ফেসবুক পোস্ট থেকে বিষয়টি জানলাম। এমনিতেই ‘দিবসে দিবসে’ আমাদের ‘হরষে বিষাদ’ অবস্থা, সুতরাং দিবস জানতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমই এখন বড় ভরসা। সেই পোস্ট দেখার পরই ‘স্বেচ্ছাসেবক’ ও ‘স্বেচ্ছাসেবা’ শব্দ দুটি মাথায় ঘুরছিল। মনে হচ্ছিল এই শব্দ দ্বয়ের সঠিক অর্থ আর উদ্দেশ্য কী আমরা জানি। এ দুইয়ের অভিধান বর্ণিত সংজ্ঞা হলো, স্ব-ইচ্ছায় সেবা কর্মই ‘স্বেচ্ছাসেবা’ এবং সেই কর্মে নিযুক্ত জনই ‘স্বেচ্ছাসেবক’। সমকালীন যে ‘সেবাকর্ম’ আমরা মাধ্যমগুলিতে দেখি তা কী ‘স্বেচ্ছা’? প্রচার সর্বস্ব এহেন কর্ম দেখার পরই এমনটা বলা। ‘স্বেচ্ছা’ মানে নিজ ইচ্ছা, ‘সেবা’ হলো নিঃস্বার্থ কাজ। সে অর্থে ‘স্বেচ্ছাসেবা’ হচ্ছে নিংস্বার্থ শ্রম। এর পেছনে কোনো প্রাপ্তির আকাক্সক্ষা নেই, থাকলে নিঃস্বার্থতা তিরোহিত হয়। এখানেই অনেকে প্রচার সর্বস্বতার সাথে ‘স্বেচ্ছাসেবা’ আর ‘স্বেচ্ছাশ্যমে’র পার্থক্যটা গুলিয়ে ফেলেন। অনেকে ডাক্তারদের শ্রমকে ‘সেবা’ বলেন। অথচ তারা ভুলে যান এই ‘সেবা’ পাবার জন্য তাদের মূল্য পরিশোধ করতে হয়। ‘সেবা’ হলো নিঃস্বার্থতা, আর টাকা দিয়ে যা কিনলেন তা হলো ‘শ্রম’। ডাক্তাররা নিজ ইচ্ছায় আপনাদের ‘শ্রম’ দিচ্ছেন এবং এর বিনিময়ে আপনি তাকে মূল্য পরিশোধ করছেন। এই ‘স্বেচ্ছাশ্রম’ তখনই সেবায় পরিণত হয় যখন ডাক্তাররা বিনা ফি’তে রোগী দেখেন। যেমন ফ্রি মেডিক্যাল ক্যাম্পে বিনা পারিশ্রমিকে রোগী দেখেন তারা। সেখানে মানুষ তাদের ‘শ্রম’ নয় ‘সেবা’ পায়। প্রাচীন পৃথিবীতে যখন মুদ্রা ব্যবস্থা গড়ে উঠেনি, তখন ছিল বিনিময় প্রথা। বর্তমান পৃথিবীতে মুদ্রা ব্যবস্থা গড়ে উঠলেও বিনিময় প্রথা বিলুপ্ত হয়নি। আমরা শ্রমের বিনিময়ে টাকা নিই, আবার বিনিময়ও করি। এই বিনিময় ব্যাপারটিই ‘স্বেচ্ছাসেবা’ ও ‘স্বেচ্ছাসেবী’ বিষয়টিকে বিভ্রান্ত করে। ‘কর্পোরেট’ পৃথিবী এতটাই প্রায়োগিক হয়ে উঠেছে যে, এখানে ‘স্বেচ্ছা’ বলতে আর কিছু নেই। প্রায়োগিক এই পৃথিবীতে সত্যিকার অর্থেই ‘কার্য-কারণ’ ছাড়া কিছুই ঘটে না। এ বিষয়ে গণ ও সামাজিকমাধ্যমের কথায় ফিরে আসি। দেখবেন ছবিসহ ‘ক্যাপশান’, ‘অমুক ভাই শীতার্ত মানুষের দুর্দশা লাঘবে শীতবস্ত্র বিতরণ করলেন’। মাঝখানে সামাজিকমাধ্যমের একটি ছবিতে দেখলাম, বেশ কয়েকজন মানুষ হাসিমুখে কিছু একটা জিনিস ধরে আছে, আর মাঝখানে একজন ‘দুর্দশাগ্রস্ত’ মানুষও বিপন্ন মুখে ওই জিনিসটাই ধরে আছে। ছবিটির নিচে প্রশ্ন, কে কাকে দিচ্ছে? এই হলো আমাদের কথিত ‘স্বেচ্ছাসেবা’র নমুনা, এই হলেন আমাদের ‘স্বেচ্ছাসেবক’! এ বিষয়ে উৎসাহী এক ‘স্বেচ্ছাসেবকে’র সাথে কথা হচ্ছিল। তিনি বললেন, প্রচার না হলে মানুষ উৎসাহিত হবে কী ভাবে, অন্যেরা এগিয়ে আসবে কী ভাবে?
বললাম, মাদার টেরেজার নাম জানেন, তিনি কী মানুষের সেবা প্রচারণার মাধ্যমে শুরু করেছিলেন? তিনি কী আমাদের ‘আইকন’ নন, ‘পাথফাইন্ডার’ নন? তাকে দেখে কী আমরা অনুপ্রাণিত হই না? হযরত মুহম্মদ (সা.) যখন নীতি নৈতিকতাহীন আরবে সংস্কার শুরু করলেন ইসলামের পতাকাতলে তখন কী কোনো মাধ্যম ছিল? তিনি কী সংস্কারের ক্ষেত্রে আমাদের ‘আইডল’ নন, ‘আইকন’ নন?
নবীন সেই ‘স্বেচ্ছাসেবক’টি আমার প্রতি প্রত্যক্ষ বিরক্তি প্রদর্শনে আলোচনার ইতি টেনেছিলেন। আমাদের ধর্মগ্রন্থ কুরআন বলে এমন ভাবে দান করতে যে, ডান হাত দান করলে যেন বাম হাত জানতে না পারে। এর একটা অর্থ হয়তো এমন হতে পারে, দানের ফলে যেন মানুষের অহংকার না আসে, সে যেন দানের বীরত্বে ‘দানবীর’ হয়ে না উঠেন। দান যখন প্রচার সর্বস্ব হয়ে দাঁড়ায় তখন দানের মহত্বটাই বিনষ্ট হয়, মানুষ ‘দান’কে নাম প্রচারের ‘বিনিময়’ ভাবে। দানের উল্টো পিঠে প্রতিদানের কথা উঠলেই তা বিনিময় হয়ে উঠে, ‘কর্পোরেট’ হয়ে উঠে।
গীতাতে বলা হয়েছে, ‘দান করা কর্তব্য এই চিন্তা করে, প্রতিদানের আশা না রেখে সৎপাত্রে, উপযুক্তস্থানে, সঠিককালে যে দান করা হয় তাই সাত্ত্বিক তথা উৎকৃষ্ট দান।’ এ অর্থেও ‘দানবীর’ হওয়ার চেষ্টা তথা প্রচার সর্বস্ব প্রতিদান পাওয়ার জন্য পাত্র, স্থান ও কাল বিবেচনা না করে দান হলো অর্বাচীনতা। আর অর্বাচীনদের দান সাধারণত ‘বানিজ্য’ হিসাবে বিবেচিত হয়।
ফুটনোট : বাইবেল বলে, ‘গ্রহণ করা অপেক্ষা বরং দান করা ধন্য বা সুখী হওয়ার বিষয়।’ সকল ধর্মই মূলত দান বিষয়ে একই ধরনের চিন্তা পোষণ বা দর্শন ধারণ করে। সুতরাং ‘স্বেচ্ছাসেবক দিবস’ ধরণের প্রচার সর্বস্ব সেবা নয়, সেই সেবা প্রয়োজন যাতে নিজ আত্মা তৃপ্ত হয় অন্যের পরিতৃপ্তিতে।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট
সম্পাদনা : আশিক রহমান