গণভবনে সেই অপরাহ্নে সবকিছু ছাপিয়ে উঠেছিল ‘নির্বাচন ইস্যু’
রাজনীতির মতো জটিল বিষয় নিয়ে যারা ভাবেন বা লেখালেখি করেন তারা নির্বাচন নিয়ে ততটা ভাবেন না। তবে রাজনৈতিক দলগুলো ঠিক এর উল্টোটি। তারা দল চালান, নেতাকর্মীদের পরামর্শ দেন, রাজনীতি করেন কিন্তু‘ মূল টার্গেট থাকে নির্বাচন; নির্বাচন অনুষ্ঠান পর্বটি থাকে মাথায়।’ কথাটি শুনেছিলাম প্রবীণ রাজনীতিবিদ ও আওয়ামী লীগ নেতা সুরঞ্জিত সেন গুপ্তের মুখ থেকে। সেটা ১৯৯১ সালের দিকে। বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমেদ তখন রাষ্ট্রপতি আর বিএনপি কেবল ক্ষমতায় বসেছে। গণতন্ত্রী পার্টির নেতা সুরঞ্জিত সেনগুপ্তও আওয়ামী লীগে যোগ দেননি তখন, তিনি যোগদান করেন ১৯৯৪ সালে। সব সময়ই স্বৈরশাসনের সমালোচক ও বিএনপির সমালোচক সুরঞ্জিত হঠাৎ জেনারেল জিয়া ও বিএনপির গুণ গাইতে শুরু করলেন। তার বক্তব্যের প্রতিবাদের মুখে ঢিঁল পড়লো জিগাতলায় তার গাড়ি-বাড়ি ও বাউন্ডারি দেয়ালে। এরপরই আমি একটি সাময়িকীতে দীর্ঘ এক সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের। রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের কথা, সুনামগঞ্জের দিরাই-শাল্লার কথা। কারণ, তার বাড়ি ও নির্বাচনী এলাকা সেটি। আমিও দিরাইয়ের মানুষ। সম্পর্কটা গভীর ও আন্তরিক এ কারণেই। অনেক বছর পর আমরা যখন পেছন ফিরে তাকাই, তখন রাজনীতির পোস্টমর্টেম করে দেখি, আসলে আমরা কী করেছিলাম, কী চেয়েছিলাম এবং কী পেয়েছি। এই সময়কালে রাজনৈতিক ব্যক্তিকে পেছনে ফেলে অরাজনৈতিক ব্যক্তিও মন্ত্রী হয়েছেন, বনেছেন প্রভাব প্রতিপত্তিধারী বিত্তশালী কেউ। একটি দৈনিক পত্রিকার মালিক মন্ত্রী হওয়ার লড়াইয়ে ‘পরাজিত’ হলেও ওই পত্রিকারই সাবেক ‘চাকরিজীবী’ সহকারী সম্পাদক এখন মন্ত্রী এবং প্রভাবশালী রাজনৈতিক দলের ‘দ্বিতীয় ব্যক্তি’। রাজনীতিতে নানারকম খেলা হয়। শুধু এদেশে নয়, উপমহাদেশে এর বহু নজির রয়েছে। তবে আমরা এখন গর্ব করতে পারিÑ বিশে^র ১৭৩ জন রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানের মধ্যে সততায় শীর্ষÑ৩-এ অবস্থান করছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নারী অধিকারের স্তম্ভ, দেশরতœ ও মাদার অব হিউম্যানিটি বলা হয় তাঁকে। এটা এতো সহজে তিনি অর্জন করেননি। তাঁকে হত্যার অপচেষ্টায় গ্রেনেড হামলা, গুলি, বোমা নিক্ষেপÑ কী করা হয়নি। অন্যদিকে দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ান এ দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন খালেদা জিয়া। বাংলাদেশ হওয়ার পর দেশে ক্ষমতার পালাবদল হয়ে থাকে দুই ধারায়। এক, ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া, দ্বিতীয়টি নির্বাচনী প্রক্রিয়ায়। এখন তো বুকে হাত দিয়েই বলা যায়Ñ এ জমানায় ক্ষমতা কেড়ে নেওয়ার দিন শেষ। এক সময় দুর্দান্ত প্রতাপশালী রাষ্ট্রপতি ছিলেন জেনারেল হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ। আমরা এরশাদের লেখা গাণ শুনিনি? বিটিভিতেÑ হায়রে কত গান। ব্যাকগ্রাউন্ডে সাবিনা ইয়াসমীন আর এন্ড্রু কিশোরের গলায় কবি এরশাদের লেখা গান, ‘নতুন বাংলাদেশ গড়ব মোরা, নতুন করে আজ শপথ নিলাম। নব জীবনের ফুল ফোটাবার, প্রাণে প্রাণে আজ দীক্ষা নিলাম।’ সেই এরশাদ এখন কোথায়? নির্বাচন নিয়ে এরশাদের আমলে একটি বাক্য রীতিমত রাজনীতিতে স্থয়ীভাবে বসবাস করা শুরু করেছিল। ‘দশটা হো-া, বিশটা গু-া থাকলে নির্বাচন ঠা-া।’ ভোটের বালাই ছিল না। কে ভোট দিল, কে দিলো না, কে ভোটকেন্দ্রে যেতে পারলো নাÑ এগুলো ধর্তব্য ছিল না। আমরা দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে এসেছি। তবে এখন গণতন্ত্র চর্চার একটি ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। শেখ হাসিনা স্পষ্ট করে বলেছেন, ‘গণতান্ত্রিক ব্যব¯’ায় আগামী নির্বাচন হতে পারে। আমরা এমন কোনো দৈন্যদশায় পড়িনি যে, এখন নির্বাচন দিতে হবে।’ কথা কী অযৌক্তিক? সাত ডিসেম্বর অপরাহ্নে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার সরকারি বাসভবন গণভবনে সংবাদ সম্মেলনে কম্বোডিয়া সফর সম্পর্কে বিভিন্ন দিক তুলে ধরার সময় নির্বাচন নিয়ে কথা বলেন। প্রায় এক ঘণ্টার সংবাদ সম্মেলনের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা নির্বাচন সংক্রান্ত বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাব দেন। বিএনপিকে ভোটে আনতে দলটির নেত্রী খালেদা জিয়ার সঙ্গে কোনো ধরনের সংলাপ বা দেশে আগাম নির্বাচনের কোনো সম্ভাবনা নাকচ করে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ‘বিএনপি নাকে খত দিয়ে নির্বাচনে আসবে। এবার আর তারা ভুল করবে না। বিএনপি নির্বাচনে আসবে কি না এটা তাদের দলীয় সিদ্ধান্তের বিষয়। এখানে সরকারের কিছু করার নেই।’ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে আগামী বছরের শেষ দিকে। তার আগে বিএনপি যদি ২০১৫ সালের মত ‘রাজনৈতিক কর্মসূচির নামে সন্ত্রাসী কর্মকা-’ চালায়, তাহলে জনগণ তার ব্যবস্থা নেবে বলে মন্তব্য করেন প্রধানমন্ত্রী। সাংবিধানিকভাবে যদি বলি; তাহলে তিন বারের প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। আমরা গণতন্ত্রের জন্য কি না করেছি। কিন্তু আসলেই কী ‘গণতন্ত্র’ জিতেছিল? খালেদা জিয়ার দল বিএনপি এখন কোথায়? প্রায় ৫০টি জেলায় সাংগঠনিক শক্তি মারাত্মক দুর্বল। দুই বছর সাজা হয়ে গেলে পরবর্তী পাঁচ বছর নির্বাচনে প্রার্থী হওয়াও যাবে না। এটা তো দলটির অনেকেরই মাথায় রয়েছে। আগামী নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, অনেকে নির্বাচন করতে চাইবে, এটাই তো স্বাভাবিক। গণতন্ত্রে শত ফুল ফুটতে দিতে হবে। এর মধ্যে যে ফুলটি ভালো, যেটি সুন্দর, সেটাই তুলে আনা হবে। নির্বাচন নিয়ে কথা হ”েছ এটা ভালো কথা। তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগ কীভাবে মনোনয়ন দেবে, সেটা সময় বলে দেবে। কী যোগ্যতা দেখবে, সেটা সবার সামনে বলার বিষয় নয়। প্রার্থী হতে চাওয়া সবার অধিকার।’ রাজনীতির শেষ কথা নির্বাচন। এ কারণেই প্রার্থী বিবেচনা সবচেয়ে কঠিন ও জটিল
একটি পরীক্ষা। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আছে এক বছর মাত্র। শুনেছি, নির্বাচনে নীতিনির্ধারকেরা ছাড়াও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তথ্য উপদেষ্টা ও পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়ের আগ্রহ রয়েছে নতুনমুখের ব্যাপারে। আওয়ামী লীগে আইন প্রণেতা হিসেবে এমপি বানিয়ে সংসদে নতুন মুখ আনা হবে প্রায় ৫০ জন। এরমধ্যে সাবেক ছাত্র নেতা, সাংবাদিক, প্রকৌশলী, চিকিৎসক, সাবেক সচিব ও ব্যবসায়ী শ্রেণির মানুষ থাকবেন। ২০১৮ সালটি নানা কারণেই অগ্নিপরীক্ষার বছর।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, কলামিস্ট ও গল্পকার
সম্পাদনা : আশিক রহমান ও মোহাম্মদ আবদুল অদুদ