হাওরে বিকল সøুুইসগেটে কৃষকদের মরণদশা : পানি সম্পদমন্ত্রী জানেন কী?
হাওরে বোরো চাষ নিয়ে শঙ্কিত কৃষকেরা। যা ৬০ বছরের ইতিহাসে কখনো ছিল না। বোরো ধান তলিয়ে নেওয়ার পর রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, সচিব, ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া, প্রিন্ট মিডিয়ার সাংবাদিকরা গিয়েছিলেন। তারা সবাই ‘কৃষকের সমস্যা এবং করণীয়’ নিয়ে বলেছেন, নির্দেশনা দিয়েছেন, সেমিনার করেছেন, লিখেছেন, টেলিভিশনে দেখিয়েছেন। ৩০ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী সুনামগঞ্জের শাল্লায় গিয়েছিলেন। নিজহাতে ত্রাণ দিয়েছেন। সংক্ষিপ্ত সমাবেশের পর বলেছিলেন, ‘ত্রাণ দেওয়া আমিই শুরু করে যেতে চাই।’ তাঁর এ উচ্চারণের মধ্যে আবেগ ছিল, ছিল আন্তরিকতা, ভালোবাসা ও ¯েœহবোধ। কৃষকদের কষ্ট তিনি বুঝতে পেরেছিলেন। মানুষের অসহায়ত্ব শুনেছেন, স্বচক্ষে দেখেছেন। তিনি ত্রাণ দেওয়ার পর প্রশাসনের লোকেরা শুরু করে। হবিগঞ্জ, সিলেট, মৌলভীবাজার, কিশোরগঞ্জে, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনার সার্বিক অবস্থা তিনি শুনেছেন ও দেখেছেন। উল্টোপাল্টা কথা বলে সুনামগঞ্জে এক সচিব তো ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের রোসানলে পড়েছিলেন। বোরো ফসল ঘরে না তোলার কষ্টের পর দীর্ঘ আট মাস গেছে। এখন বোরো মওসুমের কাজ শুরু করার সময়। কিন্তু যে সমস্যায় অতীতে কখনো কৃষকদের পড়তে হয়নি, সেই সমস্যা ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে মাথার ওপর। এর নাম ‘জলাবদ্ধতা।’ হাওরের জলাবদ্ধতা। পানিসম্পদমন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ কিছু দিন আগে গিয়েছিলেনও সেখানে। কিন্তু তিনি কী জানেন? গত বছর মার্চ মাসের শেষের দিকে পাহাড়ি ঢলে ফসলরক্ষা বাঁধ ভেঙে ১৫৪ হাওরে ফসলহানি ঘটেছিল। ২ লাখ ২৩ হাজার ৮২ হেক্টর জমির বোরো ফসলের মধ্যে সরকারি হিসাবেই সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল ১ লাখ ৬১ হাজার হেক্টর জমির ফসল। তবে কৃষকের হিসাবে এ ক্ষতির পরিমাণ প্রায় দুই লাখ হেক্টর ছিল। আমি দিরাইয়ের মানুষ। সুনামগঞ্জের দিরাই-শাল্লার কৃষকের অবস্থা খুবই নাজুক। বিভিন্ন হাওরে এখনো থই থই পানি। কবে পানি নামবে, কবে শুরু হবে বোরো আবাদÑ কেউ জানে না। সুনামগঞ্জের ২৮টি হাওরের পানি নিষ্কাশনের জন্য ৫৬টি জলকপাট (স্লুইসগেট) রয়েছে। কিন্তু এসবের অধিকাংশই এখন অকেজো। ফলে হাওর থেকে পানি নামছে ধীরে। এতে বিপাকে পড়েছেন কৃষক। বিলম্বিত হচ্ছে বোরো আবাদ। কৃষকদের সঙ্গে নিয়ে বাদালিয়া হাওর, কুলঞ্জে হাওর, ছায়ার হাওর, তুফানখালি, শনির হাওর, দেখার হাওর, পাগলার হাওরসহ নাম না জানা বহু হাওর ঘুরে দেখেছি। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় হাওরের পানি নিষ্কাশনে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে ৩০ লাখ টাকার বিশেষ বরাদ্দ দিয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) কর্মকর্তারা বলছেন, হাওর এলাকায় এখন নদী এবং হাওরের পানির উচ্চতা প্রায় সমান। তাই হাওর থেকে পানি নদীতে নামতে পারছে না। এ তথ্যও সঠিক নয়। তারা যেনো প্রকৃতির ওপর নির্ভর করে তাকিয়ে থাকবে। সব জলকপাটই সংস্কার অতীব প্রয়োজন বলে জানিয়েছেন সুনামগঞ্জ পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী আবু বকর সিদ্দিক ভুইয়া। ৫৬টি জলকপাটের মধ্যে ঠিক কতটি সচল আছে, এমন তথ্য পাউবোর প্রকৌশল বিভাগে নেই। কৃষকদের স্বার্থে নয়, অপরিকল্পিত উপায়ে, ঠিকাদারদের লুটপাটের জন্য ও দুর্নীতির মাধ্যমে লাখ লাখ টাকা অবৈধ উপার্জনের লক্ষ্যে এবং বিশেষ ব্যক্তিদের স্বার্থে এগুলো নির্মাণ ও স্থাপন করা হয়। এতে কৃষক লাভবান হয়নি। এ কারণে ১৫ থেকে ১৭ বছর বয়সী প্রতিটি জলকপাটই নষ্ট হয়ে গেছে।
বিকল হয়ে পড়া স্লুইসগেটগুলো সংস্কার না করে নতুন করে নির্মাণের প্রয়োজন কেন? এসব জলকপাট নতুন করে নির্মাণে অনেক সময়ের দরকার। পরে এগুলো নির্মাণ করা যাবে। কৃষকরা বলেন, এগুলো জলকপাট নয়, আমাদের মরণকপাট। সুতরাং কোনো বিশেষ মহলের স্বার্থে নয়, কৃষকদের স্বর্থে অবিলম্বে এগুলো অপসারণ করা দরকার। এগুলোর জন্য পানি নামছে না। অকালে বোরো ফসল তলিয়ে যাওয়ায় এখানকার মানুষ গরু-ছাগল-ভেড়া-হাঁস বিক্রি করেছে। হাড্ডিসার মানুষের আর তো বিক্রি করার অবশিষ্ট কিছু নেই। এখন অত্যন্ত স্বাভাবিক প্রশ্ন, বোরো জমি আবাদ করা পেছালে এর ফলন ঘরে তোলাও পেছাবে। প্রকৃতি আবার রুষ্ট হলে, কৃষকদের কপালি পুড়বে। এবারের ফসলহানির ধাক্কা সামলাতে পারছে না তারা। পরবর্তীকালে এ সমস্যা এলে তখন কী উপায় হবে, এ নিয়ে উদ্বিগ্ন কৃষকরা।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, কলামিস্ট ও গল্পকার
সম্পাদনা : মোহাম্মদ আবদুল অদুদ