বাবার সঙ্গে কাটানো প্রত্যেকটি মুহুর্তই এখন স্মৃতি শাহীন রেজা নূর
বাবার সঙ্গে কাটানো প্রত্যেকটি মুহুর্তই এখন স্মৃতি। তার সঙ্গে কাটানো দিনগুলো এখনও আমার কাছে চিরসবুজ হয়ে আছে। তৎকালীন সময়ের ষাটের দশকের শুরু থেকে উত্তাল রাজনীতির কথাই বেশি মনে পড়ে। ষাটের দশকে আমি একেবারেই কিশোর। কিশোর হলেও পারিবারিকভাবে সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক বিভিন্ন সংগঠনের আনাগোনা ছিল আমাদের বাসায়। দেশের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ থেকে শুরু করে সাংস্কৃতিক কর্মীরাও আসা-যাওয়া করতো। বাবার সঙ্গে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলাপ-আলোচনা করতো। তাজউদ্দিন সাহেব, মতিউর রহমান সাহেব, আওয়ামী লীগের এএইচএম কামরুজ্জামান সাহেব, ওবায়দুর রহমান, নুরে আলম সিদ্দিকী, আল মুজাহিদী সহ আরও বিভিন্ন শীর্ষস্থাণীয় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে রাজনৈতিক আলাপ আলোচনা, মত বিনিময় হতো। এর মাধ্যমে আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া, আইয়ুব খানের নিপীড়ণের বিরুদ্ধে কিভাবে আন্দোলন গড়ে তোলা যায়, সেগুলো নিয়ে তারা কাজ করতেন। এই আন্দোলনের কৌশল নির্ধারণ, ইত্তেফাক পত্রিকায় সেগুলো পাঠকের কাছে তুলে ধরা, এই কাজগুলো বাবা খুবই আনন্দের সঙ্গে করতেন। ইত্তেফাকের মাধ্যমে তৎকালীন সময়ে পাকিস্তানী ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলা, সেই কথাগুলো পাঠকের কাছে তুলে ধরা এক কথায় জনগণের সচেতনতা সৃষ্টিতে বাবা কাজ করে গেছেন। তিনি এই কাজগুলো অকুতোভয়ে করে গেছেন। শতভাগ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে তিনি কাজগুলো করতেন। সাংবাদিকতাকে তিনি চাকরি হিসেবে নেননি, তিনি সাংবাদিকতাকে একটি ব্রত হিসেবে নিয়েছিলেন। এই মিশনকে সফল করতে তিনি যে কোনো ধরণের চাপকে অগ্রাহ্য করার ক্ষেত্রে ছিলেন একেবারে বদ্ধপরিকর।
সেই দিনগুলো আমার এখনও মনে পড়ে। ৬ দফা আন্দোলন, ৭ জুনের হরতাল, ৬২ সালে যখন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে গ্রেফতার করা হলো, সেই সমস্ত বিষয় তিনি পত্রিকার মাধ্যমে সাধারণ মানুষের কাছে পৌছে দিতেন। ১৯৬৪ সালে যখন দাঙ্গা লাগলো তখন তিনি ‘পূর্ব বাংলা রুখিয়া দাঁড়াও’ সেই নির্দেশনা, হেডলাইন, ব্যানার করতেন। পরবর্তীতে দাঙ্গা প্রতিরোধ কমিটি গঠিত করা হলো। সেখানে মানিক মিয়াকে আহবায়ক করা হলো। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে মিটিং করে সেখানে তিনি অন্যতম ভুমিকা পালন করলেন। বেসিক ডেমোক্রেসি ইলেকশন নিয়ে নিয়মিত লেখালেখি করতেন। আইয়ুব খানের নিপীড়ন, মিথ্যাচার, সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে নানা কৌশলে তিনি লিখতেন। কারণ, সেই সময় এ ধরণের খবর ছাপানোটা কঠিন ছিল। পাকিস্তানে যে সমস্ত খবর স্বাধীনভাবে তখন ছাপানো যাচ্ছিল না, তিনি তখন সেই খবরগুলোকে ভিন্নভাবে সাজিয়ে পাঠকের কাছে তুলে ধরতেন।
বাবা সব সময় একটি গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখতেন। তিনি ছিলেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর অনুসারি। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের স্বপ্ন তিনি দেখতেন। মানুষের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠা করা, সম বন্টন, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা এই সমস্ত বিষয়গুলো ছিল তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। মানুষের মৌলিক এবং মানবিক অধিকার প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখতেন তিনি এবং সেই লক্ষ্যে আজীবন নিরলসভাবে কাজ করে গেছেন।
পরিচিতি : নির্বাহী সম্পাদক, দৈনিক ইত্তেফাক ও শহীদ বুদ্ধিজীবি সন্তান
সাক্ষাৎকার গ্রহণ : সাগর গনি
সম্পাদনা : মোহাম্মদ আবদুল অদুদ