রায়েরবাজার বধ্যভূমি এখনো জাগ্রতঅজয় দাশগুপ্ত
বিষয়টা যেভাবে ভাবা উচিত ঠিক সেভাবে ভাবিনা আমরা। বছরের পর বছর পেরিয়ে কেবল আনুষ্ঠানিকতা আর শোকের কথায় আবদ্ধ শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস মূলত এক ঘোর বিপদের দিন। দুনিয়ার অনেক দেশে মুক্তিসংগ্রাম হয়েছে এবং মুক্তিকামী মানুষেরা জয়ী ও হয়েছেন। জান মাল বা ভয়াবহতার দিক থেকে ভিয়েতনামের যুদ্ধ বা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ আরো ভয়াবহ। কিন্তু আমাদের সাথে তাদের তফাৎ দুটো। প্রথমত বিজয়ের পর সেসব সমাজ বিজয়ীদের মেনে নিয়ে সেভাবে চলছে। দ্বিতীয়ত আর কোন দেশে বিজয়ের ঠিক আগে এভাবে পরিকল্পিত উপায়ে দেশ ও জাতিকে মেধাহীন করা হয়নি। আমাদের দেশে পরাজিতেরা যতদিন বিজয়ীদের কোণঠাসা করার চেষ্টা চালাবে ততদিন এই দিবস একদিকে যেমন শোকের আরেকদিকে আতঙ্ক আর ভয়ের হয়ে থাকবে।
পাকিস্তানীরা দখলদার ছিলো। তারা ভূমি ও সম্পদ ছাড়া আর কিছু চাইতো না। আমাদের তারা গাদ্দার বলতো আর যখন বুঝেছিল আমরা সাথে থাকবো না তখন মেরে ফেলাই ছিল তাদের উদ্দেশ্য। তাদের চেয়েও ভয়ানক ভূমিকা পালন করেছিল মূলত দেশীয় দালালেরা। তারা কতটা ভয়ংকর ছিলো তার এক নির্লজ্জ দলিল এই বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ড। যেসব মানুষেরা অস্ত্র দূরে থাকুক চাকুও চালাতা জানতেন না যাদের হাতে ছিল কলম, তুমি বাঁশী যাদের গলায় ছিল সুর কবিতা যাদের মেধায় ছিলো শুদ্ধতা আর ভালোবাসা তাদের কেন মারলো তারা? কারণ তারা জানেন এদেশ স্বাধীন হলে এরাই হবেন পথিকৃৎ। এরা যেমন পাকিস্তানের নাগপাশ থেকে মুক্তির পথ দেখিয়েছেন তেমনি দেখাতে পারবেন নতুন দেশ গড়ার পথ। সে কারণেই এদের হত্যা করা হয়েছিল। বেছে বেছে নৃশংস পদ্ধতিতে।
যতবার ভাবি এক অজানা বেদনা আর এক উন্মত্ত আক্রোশে আমি যূগপৎ শোকার্ত আর উদ্দীপ্ত হয়ে উঠি। ছবিগুলোর দিকে তাকালেই দেখবেন নীরিহ ভদ্রলোক কাকে বলে। কি মায়া আর ভালোবাসা এদের চেহারায়। এদের সন্তানদের দিকে তাকান। আজ এতবছর পরও মা বাবা ভাই হারানোর বেদনায় এরা রাষ্ট্র আর সরকারের কাছে কাঁদছে। তারা কি শাসনভার চায়? না রাজনীতি করে তারা? কিছুই না। তাদের চাওয়া একটাই যেদেশের জন্য শৈশব না ফুটতে বা যৌবনে তারা পিতা হারিয়েছিল সে দেশের ভালো চায় বলে দেশকে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে নিয়ে যেতে চায় । রাজনীতির যে দুটো ধারা দেশে প্রবহমান তারা কি করে?
একদিকে আছে আশ্বাস আর প্রতিশ্রুতি। ভোর সকালে সেজেগুজে তৈরী হয়ে মিরপুর যাওয়া রায়েরবাজারে গিয়ে সম্মান জানানোর রেওয়াজ। আরেকদিকে চলছে সংখ্যা নিয়ে পৈশাচিকতা নিয়ে সত্য মিথ্যা নিয়ে কলহ। যারা তা করে তারা একদিন এমন ও বলবে এইসব মানুষেরা নিজেরাই হয়তো রায়েরবাজার গিয়ে শুয়ে পড়েছিলেন। যেমন এক হিন্দু বিএনপি নেতা মনে করেন মুক্তিযুদ্ধে আসলে বেশী মানুষ মরে নাই। এজন্যে আমি বলি দেশে আসলে এমন অজ¯্র সংখ্যালঘু নামের মানুষও এখন আছে যারা ধর্মীয় পরিচয়ে সংখ্যাগুরু হলে নির্ঘাৎ রাজাকার হতেন। আজ রাজাকারের সংজ্ঞা পাল্টে গেছে। যারা বুদ্ধিজীবী হত্যা কিংবা ইতিহাস নিয়ে বাহাস করেন তারা রাইফেল নিয়ে পাকিদের সাথে যাওয়া দালালদের চাইতেও ভয়ংকর।
বাংলাদেশে স্বাধীন হয়েছে অনেকবছর। এতবছর পর সব আবেগ আগের জায়গায় থাকবে এটা আশা করাও বাতুলতা। সে আবেগের জায়গাটা সরকারি দলের নব্য নেতারা নষ্ট করেন অধিক। তারা নিজেদের স্বার্থে মুক্তিযুদ্ধের এস্তেমাল করতে করতে চেতনার ধার কমিয়ে ফেলছেন। সাধারণ মানুষের মনে দেশ ও ইতিহাস নিয়ে যে আবেগ তাকে এভাবে নষ্ট করার দায় এড়াতে পারেন না তারা। আমাদের মনে একটাই প্রশ্ন শুদ্ধ ইতিহাস আর বিজয়ের কাহিনী নিয়ে দ্বন্দ্বেই কি শেষ হয়ে যাবে দেশের ভবিষ্যত? যদি তা না হয়, যদি বাংলাদেশকে আমরা অপরিবর্তিত ও মুক্তিযুদ্ধের আলোকে দেখতে চাই তাহলে আজকের দিনটিকে মূল্যায়ন করুন। যারা বুদ্ধিজীবীদের সন্তান তাদের সম্মান দিন। তাদের নতুন প্রজন্মের কাছে পরিচিত করানোর কাজটি করতে এত দ্বিধা কেন? এরাই তো তারা যারা কোনদিনও পিতার হত্যাকারীদের মাফ করবে না। আর এরা যদি সামনে না থাকে নতুন প্রজন্ম কিভাবে জানবে কাকে সম্মান করতে হয় কাদের রাখতে হয় আদর্শ হিসেবে সামনের কাতারে?
আরো একটা কথা শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসের গুরুত্ব এখনো অটুট। দেশে মানুষের জীবনতো বটেই বিশেষত মেধা সম্পন্ন আলোকিত মুক্তিবুদ্ধির মানুষের জান এখনো সংকটে। নানাভাবে তাদের ওপর চড়াও হবার মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। আজকাল গান গাইলেও বিপদে পড়তে হয়। কবিতা লিখলে অনিরাপদ, ধ্যান করলেও বিপদের সম্ভাবনা এড়ানো যায় না। এজন্যে কেবল কিছু মানুষকে টার্গেট করে সন্ত্রাসী নাম দিলেই সমাধান মিলবে না। সমাজের এই রোগ সারানো দায় সংস্কৃতির। তাকে জাগিয়ে তুলতে হবে। মূলত এখন সে কাচের পাত্রে রাখা জিয়াল মাছ। যাদের দরকার তারা বের করে আনে। কেউ পুরষ্কার পায়। কেউ রেঁধে খায়। এভাবে চললে দেশে আর মেধা বা মগজের দরকার পড়বেনা একদিন।
যেসব বুদ্ধিজীবীরা নিজেদের প্রাণ উৎসর্গ করে আমাদের মুক্তির পথ দেখিয়ে গিয়েছিলেন তাদের হত্যাকারীরা এখনো আছে। আড়ালে আবডালে বাড়ছে তারা। সবচেয়ে বড় কথা সমাজ সংসারে এখন মুক্তবুদ্ধি আছে ঘোর সংকটে। সেইসব মানুষদের কাছে গিয়েই দাঁড়াতে হবে যারা লড়াই করেছিলেন কলম, তুলি, সুর আর মেধা দিয়ে। সেই কবে লেখা একটা ছড়ার কথা আজো প্রাসঙ্গিক বিবেচনা করি:
এদেশেতে দাঁড়িয়ে আজো লিখছো গদ্য পদ্য তুমি
বাজাও বাঁশী ভোলাও প্রাণ
ভালোবাসায় গাইছো গান?
চোখের তারায় জাগিয়ে রেখো রায়েরবাজার বধ্যভূমি।
এমন কঠিন সময় ও ইতিহাস আর কোনদিন না আসুক কোন জাতির জীবনে। জয় হোক তাদের জীবনবোধের।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষক