সোহরাওয়ার্দী উদ্যান কথা বলে
মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আলী শিকদার (অব.)
১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস উপলক্ষে সারা বাংলাদেশ সেজে ছিল লাল-সবুজের উৎসবে। রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এদিন লাখ লাখ মানুষের পদচারণায় ছিল কানায় কানায় পূর্ণ। বরাবরের মতো সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম মুক্তিযুদ্ধ ৭১ কর্তৃক আয়োজিত বিজয় দেখার অনুষ্ঠানটি ছিল আগত দর্শকদের মূল আকর্ষণ। স্থান- সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের শিখা চিরন্তন বেদী সংলগ্ন স্বাধীন চত্বর। উদ্যানের ভেতরে অন্যস্থানে অন্য সংগঠন কর্তৃক আরো অনুষ্ঠান ছিল। সূর্য হলে পড়ার পর থেকে চতুর্দিক হতে মানুষ স্র্রোতের মতো আসতে থাকে সোহরায়ার্দী উদ্যানের দিকে। দলে দলে মানুষ আসছে হেঁটে, কেউবা রিকশায়, আবার ডজন ডজন বাস-ট্রাক বোঝাই করে আসছে মানুষ। আছে সব বয়সের ও শ্রেণি-পেশার নারী পুরুষ। এ বছরের ছোট শিশু থেকে আছে অশতিপর বৃদ্ধ-বৃদ্ধা। গায়ে লাল-সবুজ, আর মুখে হাসি। এ সৌন্দর্য না দেখলে বুঝা যায় না। এত আনন্দ বাংলাদেশের মানুষের। ভাবতে অবাক লাগে। মনে হয়, এমন বাংলাদেশই তো আমরা চেয়েছি। মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক নাচ, গান, কবিতা ও নৃত্যনাট্য নিয়ে সাজানো সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম কর্তৃক আয়োজিত অনুষ্ঠানটি প্রায় সোয়া ঘণ্টা ধরে অগণিত দর্শক শ্রোতাদের তন্ময় করে রাখে। নরসিংদী জেলার সাংস্কৃতিক সংগঠন বাঁধনহারা কর্তৃক নৃত্যনাট্য ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’ মঞ্চায়ন দেখে সামনের সারিতে বসা মুক্তিযোদ্ধারা চোখের পানি ফেলেছেন। তাতে যোগ দিয়েছে আরো অনেকে। সেই ১৯৭১ সালে সেপ্টেম্বর মাসে যশোর থেকে কোলকাতার দিকে হাঁটতে থাকা হাজার হাজার অসহায় নারী-পুরুষের নিদারুণ কষ্টের বাস্তব দৃশ্য দেখে বিখ্যাত কবি অ্যালেন গিনসবার্গ লেখেন বিখ্যাত কবিতা ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’। একটি কবিতা সারা বিশ্বকে নাড়িয়ে দেয়। এই কবিতার অবলম্বনে নরসিংদীর বাঁধনহারা সাংস্কৃতিক সংগঠন মঞ্চস্থ করে নৃত্যনাট্য যশোর রোড। স্বল্প সময়ে অত্যন্ত নিখুঁত ও হৃদয়গ্রাহীভাবে বাঁধনহারার প্রায় ৪০-৪৫ জন তরুণ ছেলেমেয়ে তুলে ধরে বাঙালি জাতির পুরো ইতিহাস। ১৭৫৭ সালের পলাশীর প্রান্তর, ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহ, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা, একাত্তরের ৭ মার্চের ভাষণ, ২৫ মার্চসহ ৯ মাস পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যা এবং ১৬ ডিসেম্বর বিজয়। অংশগ্রহণকারী প্রত্যেকটি ছেলে-মেয়ের পারফরমেন্স ছিল একেবারে জীবন্ত। ৩০ মিনিটের বাঁধনহারার এই অনুষ্ঠানটি পিন পতন নিরবতায় হাজার হাজার দর্শক অপলক নেত্রে দেখেছে এবং চোখের জল ফেলেছে। এরাই আমাদের তরুণ প্রজন্মের প্রতিনিধি। এরাই গড়বে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের ছাত্রদের চিত্রায়নে দর্শক শ্রোতাগণ চাক্ষুষ দেখতে পান ভারত-বাংলাদেশ যৌথ বাহিনীর সেনাপতি লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎসিংহ অরোরার কাছে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর সেনাপতি এ এ কে নিয়াজি অবনত মস্তকে সারেন্ডার করে তার অস্ত্র তুলে দিচ্ছেন। নিয়াজির অস্ত্র সারেন্ডারের দৃশ্য দেখামাত্র উপস্থিত হাজার হাজার দর্শক শ্রোতা স্বতঃস্ফূর্তভাবে জয় বাংলা জয় বাংলা শ্লোগানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের শূন্য আকাশকে মুখরিত করে তুলে। সে এক অপূর্ব দৃশ্য। যারা একাত্তর দেখেনি, তারা ২০১৭ তে এসে দেখল বিজয়ের আনন্দ কেমন হতে পারে। সে আনন্দ একটা জাতিকে কিভাবে উজ্জীবিত করতে পারে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঠিকই বলেছেন, ‘বাঙালি জাতিকে কেউ দাবিয়ে রাখতে পারবা না’। ১৯৭৫ সালের পরে একাত্তরের পরাজিত শক্তি, ঘাতক, দালাল, রাজাকার, যুদ্ধাপারধীরা মিলে বাঙালির গৌরবোজ্জ্বল এই ইতিহাসকে দাবিয়ে রাখতে চেয়েছে, এখনো সে চেষ্টা অব্যাহত আছে। কিন্তু ১৬ ডিসেম্বরে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান বলছে ওরা সফল হয়নি, আগামীতেও হবে না। কারণ, এই সোহরাওয়ার্দী উদ্যান আমাদের সর্ব গৌরবোজ্জ্বল ঘটনার সাক্ষী। অত্যন্ত সুকৌশলে শিশু পার্ক বানিয়ে ওই গৌরবকে ঢেকে দেওয়ার অপচেষ্টা করা হয়। কিন্তু তারা সফল হননি। কারণ, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মাটি কথা বলে। বাংলাদেশ যতদিন থাকবে, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানও ততদিন থাকবে। এই উদ্যান একাত্তরের ৭ মার্চের কথা বলে। বলে, তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে। আরো বলে, একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর তোমাদের কাছে পাকিস্তানের ৯৩ হাজার সৈন্য অবনত মস্তকে সারেন্ডার করেছে। তোমরা বিজয়ী জাতি, মাথা উঁচু করে দাঁড়াও। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি এলে বঙ্গবন্ধুর কথা মনে করিয়ে দিবে। বলবে, সাড়ে সাত কোটি বাঙালি আজ মানুষ হয়েছে। এই উদ্যান বলে, ভারত-বাংলাদেশের বন্ধুত্ব রক্তে লেখা, যার স্বীকৃতি স্বরুপ এই উদ্যানে দাঁড়িয়ে ঘোষণা দেন দুই দেশের দুই মহান নেতা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী। ৪৬ বছর পর সেই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছ থেকে জাতীয় পতাকা গ্রহণ করে এ প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা ঘোষণা করেছে, আমরা জামায়াত, যুদ্ধাপরাধী ও জঙ্গি মুক্ত বাংলাদেশ চাই। মুক্তিযোদ্ধার প্রত্যাশা ব্যক্ত করেছে, এই নতুন প্রজন্ম জাতীয় পতাকার মর্যাদা রক্ষা করবে, গড়বে পরিপূর্ণ অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ। সত্যিই সোহরাওয়ার্দী উদ্যান কথা বলে, বলবে চিরকাল।
লেখক : কলামিস্ট ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক