কলিকাল ও সহনশীলতা বিষয়ক
আমাদের শিক্ষামন্ত্রীর সহনশীলতা বিষয়ক একটি বক্তব্য নিয়ে সামাজিক ও গণমাধ্যমে মাতম দেখছি। ইতোমধ্যে উনার বক্তব্য অনলাইনে ভাইরাল হয়ে গিয়েছে। অত্যন্ত ভদ্র ও সজ্জন বলেই উনি এসব বিষয়ে অসহনশীল না হয়ে, প্রেসকনফারেন্স করেছেন। ব্যাখ্যা দিয়েছেন তার বক্তব্যের ব্যাপারে। এখানে তিনি বক্তব্যের ‘টাইমফ্রেম’টা পিছিয়ে দিয়েছেন। সময়টা চলে গিয়েছে ‘অসহনশীল’দের বিস্মৃত প্রায় বিএনপি জোটের ক্ষমতাকালীনে। অবশ্য তার সেই বক্তব্যও ছিল অত্যন্ত সহনশীল মাত্রার। আমরা অনেক রাগী মানে ‘ইয়ে’ দেখেছি, সে তুলনায় শিক্ষামন্ত্রী অনেক সহনশীল এবং সজ্জন। আর এ কারণেই তিনি ‘সহনশীলতা বিষয়ক’ পরামর্শ প্রদানের নৈতিক অধিকার রাখেন। তার বক্তব্যের ‘হিউমার’টি অনেকে ধরতে পারেন নি। সে জন্যেই ‘যুগান্তরে’র সাথে আলাপনে তিনি সহনশীলমাত্রায় অভিমান প্রকাশ করে বলেছেন, অনেক সাংবাদিকরা ‘হিউমার’ বোঝেন না তথা রসজ্ঞানহীন বলে। সজ্জনতার কারণেই তিনি অন্তত তুলনা দিয়ে বলেন নি, ‘পোষা যায়’, এমন কথাটি। এটাই বা কম কী সে। বলতে পারেন, ক্লিশে প্রাপ্তি। পোষা যে যায়, তা নিয়ে কিন্তু এত অসহনশীল কথাবার্তা শুনিনি, পড়িনি। কথা যখন অসহনশীল পর্যায় থেকে আসে তখন শ্রোতাদের সহনশীল হতে হয়; বক্তা সহনশীল হলে শ্রোতারা হয়ে উঠেন অসহনশীল। বীরভোগ্যা বসুন্ধরার হয়তো এটাই নিয়ম। সহনশীল বলেই হয়তো শিক্ষামন্ত্রীকে নিয়ে এত কথা।
তবে হিউমার না বোঝার ব্যাপারে শিক্ষামন্ত্রীর কথায় একটুখানি দ্বিমত রয়েছে। হিউমার বিষয়ে তার অভিমান বা অভিযোগ সর্বক্ষেত্রেই ঠিক নয়। মাধ্যম সংশ্লিষ্টদের অনেকেই চরম মাত্রায় সহনশীল। তাদের অতি নরম, বিগলিত, তেলতেলে ভাষা শুনে জাতি অভ্যস্ত। তাদের ঠোঁটের কোন নিঃসৃত হিউমারের ব্যাপারেও জাতি অবহিত। সব অর্জন যারা ‘সহনশীলতা’র জন্য এক কথায় বর্জন করার দুলর্ভ গুন ধারণ করেন তারা অবশ্যই অতি ‘সহনশীল’ এবং সজ্জন। এমন কী প্রশ্নফাঁসের প্রকোপ, বাজারে তেল, চাল, পেয়াজের মূল্যবৃদ্ধিও তাদের এমন সজ্জনতার, সহনীশলতার কোন পরিবর্তন আনে না। সুতরাং সঙ্গত কারণেই ‘হিউমার’ তথা রসজ্ঞান সম্পর্কিত বক্তব্যে ‘সহনশীল’ মাত্রার এই দ্বিমত। তবে সহনশীলতার এমন মিশালের বিপরীতে চালের দাম নিয়ে অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য কিন্তু ঠিকঠাক যায়নি। তিনি বলেছেন, ‘চালের দাম অসহনীয়’। ‘শরীরের নাম মহাশয়, যা সহাবে তাই সয়’ ছোটবেলায় শেখা এমন আপ্তবাক্য সম্ভবত অর্থমন্ত্রী মহোদয় বিস্মৃত হয়েছেন।বয়সও একটা ‘ফ্যাক্টর’, এ বয়সে বিস্মৃতি দোষের কিছু নয়। তবুও বলার ক্ষেত্রে সহনশীল হওয়া উচিত। এই যে ধরুন আমাদের যমুনা সেতুর খরচের সাথে ভারতের একটি সেতুর খরচের তুলনা করেন অনেকে। সে তুলনায় খরচের পার্থক্যও অসহনীয়। কিন্তু তারপরেও আমাদের দেশের মানুষ তা সইয়ে নেয় নি? ফোর লেন, ফ্লাইওভারসহ বিভিন্ন প্রকল্পে কত খরচ, কোথায় কী হচ্ছে, এমন বিষয়ে কী অসহনশীল হয়েছে আমাদের আমপাবলিক? এমন কী প্রশ্নফাঁসের অসহনীয় তান্ডবও তো তারা সয়ে নিয়েছেন। কিছু ‘মাধ্যমবাজ’ অসহনশীল হলেও অন্যেরা কিন্তু অতি ‘সহনশীল’ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। এমন অবস্থায় চালের দাম নিয়ে ‘অসহনীয়’ বক্তব্য ‘পঁচা গমে’র মতন একেবারেই সহজপাচ্য নয়।
সমাজে এখন ‘সহনশীল’ মানুষ বড়ই প্রয়োজন। সামাজিক নিরাপত্তা যখন ক্রমেই ভেঙ্গে পরছে। ধর্ষণ হচ্ছে, লাশ পরছে, বাড়ছে নিখোঁজ সংবাদ এমন অবস্থায় ‘সহনশীল’ তথা সয়ে নিতে পারা মানুষের কোন বিকল্প নেই। মনে রাখতে হবে ‘শরীরের নাম মহাশয়’, সয়ে নিতে হবে, হতে হবে সহনশীল। সব কিছুতেই ‘অ্যাংরি ইমেজ’ ভালো নয়। কিছু একটা হয়ে গেলেই এমন কিছু অসহনশীলের ‘চিল্লাফাল্লায়’ টেকা দায়। বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম তো একেবারে জ্বলন্ত উনুন হয়ে উঠে, তার উপর ফুটন্ত কড়াই কিছু গণমাধ্যমতো রয়েছেই। ‘ঠান্ডা ঠান্ডা কুল কুল’ এ কথাটি তাদের মাথায়ই থাকে না। এরা নিজের ভালোটাও বোঝে না। অসহনশীল হলে ব্লাড প্রেসার হাই হয়, স্ট্রোক আর অ্যাটাকের সমূহ সম্ভাবনা দেখা দেয়। এতবড় স্বাস্থ্য ঝুকি নিতেও বাধে না বেকুব ধরণের এমন মানুষদের। সহনশীলতার কোন শিক্ষাই এদের নেই। ‘নিজে বাঁচলে বাপের নাম’ এই প্রবাদ বাক্যটিও এদের অজানা। আছে শুধু ‘নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো’র কাজ। ঘোর কলি একেই বলে। ‘আইলো এমন কলিকাল, ছাগলে চাটে বাঘের গাল’ এমন অবস্থা আর কী।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট
সম্পাদনা : মোহাম্মদ আবদুল অদুদ