শেখ হাসিনা যখন জনগণের আস্থার প্রতীক
শেখ হাসিনা রচনাসমগ্রের প্রথম খ-ের ভূমিকায় লেখা রয়েছে, ‘রাজনৈতিক পরিবারে জন্ম আমার। পিতা জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক আদর্শের মধ্য দিয়ে বড় হয়েছি। একদিন যে আমাকেও তাঁর মতো রাজনৈতিক নেতৃত্ব দিয়ে দেশ পরিচালনা করতে হবে ভাবিনি। সময়ের দাবি আমাকে এখানে এনে দাঁড় করিয়েছে। পিতার স্বপ্ন ছিল বাংলার দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানো। আমি এই আদর্শ নিয়ে বিগত ২৮ বছর যাবৎ জনগণের সেবক হিসেবে রাজনীতি করে যাচ্ছি।’ ৬ জানুয়ারি (২০১৮) শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘আমাদের জীবন থেকে ২৮ বছর হারিয়ে গেছে। আর যেন একটা দিনও হারাতে না পারে।’ উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখার জন্য তিনি এ কথা বলেছেন। এছাড়া যারা আল-বদর ও যুদ্ধাপরাধীদের নিয়ে চলে তারা ক্ষমতায় এলে দেশের জনগণের কল্যাণ হবে না বলে তিনি মনে করেন। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের চতুর্থ বর্ষপূর্তির পরদিন গণভবনে আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে তিনি আরো বলেন, ‘পাঁচই জানুয়ারির নির্বাচন কোনোভাবেই ভোটারবিহীন হয় নি। ৪০ পার্সেন্টের ওপর ভোট পড়েছিল। …ওই নির্বাচনে তারা (জনগণ) ভোট দিয়েছে বলেই আমরা চার বছর পূর্ণ করতে পারলাম।’
২.
বর্তমান মেয়াদের চার বছর এবং গত মহাজোট সরকারের পাঁচ বছর মোট ৯ বছর একটানা শাসন ক্ষমতায় আসীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। একটানা ক্ষমতায় টিকে থাকার কারণ কি? তিনি কেন জনগণের আস্থার প্রতীকে পরিণত হয়েছেন? এ প্রশ্নের উত্তর অন্বেষণে দু’একটি প্রসঙ্গের অবতারণা করা যায়। শেখ হাসিনা ছাত্র জীবন থেকেই রাজনীতিসম্পৃক্ত। ১৯৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় তাঁর সহপাঠীরা স্মৃতিচারণ করে বলেছেন, ‘হাসিনার ছিল একটা আকর্ষণীয় ক্ষমতা, সবার সঙ্গে খুব সহজেই মিশতে পারতো। একেবারে সহজ-সরল আন্তরিকতায় ভরা মন। সবার মন জয় করার একটা মুগ্ধময় ক্ষমতা ছিল তার। তার সঙ্গে আমার মনের মিল ছিল যথেষ্ট। বিশেষ করে বই পড়া, গান শোনা, আড্ডা, সভায় মিছিলে যাওয়া এবং ছাত্র রাজনীতির কাজকর্ম করা। যদিও দু’জনে দুই সংগঠনে তারপরও আমাদের মধ্যে বন্ধুত্বের সম্পর্ক বেশ ঘনিষ্ট ছিল। তার কথাবার্তা, চিন্তা ভাবনার সঙ্গেও তখন থেকে আমি সহমর্মী হই। তার জনদরদী মন আছে যা আমাকে স্পর্শ করে থাকে। তার প্রথম পছন্দ বই পড়া। বই উপহার পেলে তিনি সবচেয়ে বেশি খুশি হয়ে থাকেন। নিঃস্বার্থ দেশপ্রেমিক নেতা এবং অনন্য সাধারণ ব্যক্তিত্ব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত।’ (বেবী মওদুদ, ২৭/৯/২০১০)
পিতার রাজনৈতিক আদর্শ, আন্দোলন-সংগ্রাম-কারাবন্দী জীবন সবই তিনি শৈশব-কৈশোর থেকেই দেখেছেন। এই অভিজ্ঞতা তাকে পিতার আদর্শ উত্তরাধিকারী হিসেবে গড়ে তোলে। তিনি যখন আজিমপুর গার্লস স্কুলে অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী, তখন তিনি নেতৃত্ব দিয়ে ছাত্রীদের নিয়ে শিক্ষা আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলার বিক্ষোভ সমাবেশে যোগ দেন। এসময় পুলিশ তাদের ওপর লাঠিচার্জ করেছিল। এরপর ঢাকার উচ্চ মাধ্যমিক মহিলা কলেজের ছাত্রী সংসদ নির্বাচনে সহ-সভাপতি নির্বাচিত হয়ে কলেজের ছাত্রীদের সমস্যা সমাধান ও সংস্কৃতির কর্মসূচির নেতৃত্ব দেন। কলেজে শহীদ মিনার প্রতিষ্ঠায় তাঁর অবদানের কথা লেখা আছে শেখ হাসিনার নিজের রচনায়। ‘আমাদের দেশে ছাত্র রাজনীতির ঐতিহ্য ছিল অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার আন্দোলন করার জন্য। ছাত্র রাজনীতির এই ঐতিহ্য নষ্ট করার জন্য এবং আইয়ুব খানের আমলেই ছাত্র রাজনীতিতে অস্ত্রধারীদের মহড়া শুরু হয়। মেধাবী গরিব ছাত্রদের অর্থ দিয়ে ছাত্র রাজনীতি ধ্বংসের এই চক্রান্ত আজও বিদ্যমান।’(স্কুল জীবনের কিছু স্মৃতিকথা, সাদা কালো) বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, একাত্তরের অসহযোগ আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন তিনি। তাঁর পিতার রাজনৈতিক জীবনকে খুব ঘনিষ্ঠভাবে দেখার সুযোগ হয়েছিল বলেই তিনি বঙ্গবন্ধুর মতো বাংলার মানুষকে গভীরভাবে ভালোবাসেন। ১৯৮১ সালের ১৭ মে আওয়ামী লীগের সভানেত্রী হয়ে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করে বলেছেন- ‘আমার একমাত্র দায়িত্ব পিতার অধরা স্বপ্ন সফল করা।’ শেখ হাসিনা বলে থাকেন, ‘জনগণের ভাত ও ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠা করাই আমার রাজনীতি।’ শিশুদের মধ্যে ভবিষ্যৎ দেখতে ভালোবাসেন, ‘শিশুরা আমাদের দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ। আমাদের বর্তমানকে উৎসর্গ করে তাদের ভবিষ্যতকে আনন্দ, উজ্জ্বল, স্বস্তি ও শান্তিময় করে তুলতে হবে।’ শেখ হাসিনা দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় আন্দোলন ও সংগ্রাম, সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে সাহসী যোদ্ধা, বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় সোচ্চার প্রবক্তা এবং রাজনৈতিক দূরদর্শীতার কারণে তাঁকে বিশেষভাবে শান্তি পুরস্কার ও সম্মানীয় ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করা হয়। যে কোনো সংকট মুহূর্তে কিংবা প্রতিকূল পরিস্থিতিতে শেখ হাসিনা ত্বরিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ১৯৮২ থেকে আজ পর্যন্ত অনেকগুলো রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত তিনি প্রচ- দৃঢ়তার সঙ্গে নিয়েছেন। প্রতিকূল পরিবেশ, সহকর্মীদের শত বাধা এবং সুশীল সমাজ কিংবা অন্যান্য রাজনৈতিক দলের চিন্তা-চেতনা সম্পূর্ণরূপে তাঁর বিপক্ষে থাকার পরও তিনি এগিয়ে গিয়েছেন। ১৯৮৬ সালের সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়ে এবং পরবর্তীতে আবার সংসদ থেকে বের হয়ে আসা একটি বিশাল ব্যাপার ছিল। ১৯৯১ সালের পর বিএনপিবিরোধী আন্দোলনে সফলতা, ১৯৯৬ সালের সরকার প্রধান হিসেবে সাফল্য যেমন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা তেমনি ১/১১’র প্রেক্ষাপটে অতি দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ অনন্যসাধারণ। সব শেষে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনটি তিনি করেছিলেন দূরদর্শী রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে- বিরোধী পক্ষসহ তাবৎ দুনিয়ার ক্ষমতাবান রাষ্ট্রশক্তির হুমকি-ধামকি উপেক্ষা করে কেবলমাত্র নিজের দলের অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থে। এজন্য তাঁর উপলব্ধি তাৎপর্যবহ-‘বাংলাদেশের জনগণের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। জনগণের ভাগ্য পরিবর্তন করে উন্নত জীবন নিশ্চিত করতে আমি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। তাদের ভালোবাসার প্রতিদান আমাকে দিতেই হবে। জনগণের জন্য একটা সুন্দর, উন্নত জীবন উপহার দেব, এই আমার প্রতিজ্ঞা।’(সবুজ মাঠ পেরিয়ে, সবুজ মাঠ পেরিয়ে)।
লেখক : অধ্যাপক এবং পরিচালক, জনসংযোগ, তথ্য ও প্রকাশনা দপ্তর, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
সম্পাদনা : মোহাম্মদ আবদুল অদুদ