বাংলা সাহিত্যের ঐতিহ্য নির্মাতা প্রাকৃতজন শওকত আলী জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে ‘ভোটের রাজনীতিতে শওকত আলী গুরুত্বপূর্ণ নয়, তার খোঁজ কেউ নেয় না’
বিশ্বজিৎ দত্ত, আশিক রহমান ও রিকু আমির : সাহিত্যিক শওকত আলীর ছেলে আসিফ শওকত কল্লোল জানিয়েছেন, তার বাবার অবস্থার আরো অবনতি হয়েছে। তিনি জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে চলে গেছেন। ডাক্তাররা লাইফ সাপোর্টে তাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। সরকারের তরফ থেকে কেউ কি তার বিষয়ে কোনো খোঁজ করেছেন? কল্লোল জানান, না, উনি তো ভোটের রাজনীতিতে তেমন গুরুত্বপূর্ণ নন। উনার খবর কে নেবে। তবে সাধারণ মানুষ উনার বন্ধু ও পাঠকেরা অনেকেই খোঁজ করেছেন। ভালবাসা থেকেই এই খোঁজ-খবর। ভালবাসাহীন মানুষ যারা অন্যভাবে উনার খোঁজ নেবে তাদের খোঁজ দিতেও চাই না।
অন্যদিকে শওকত আলীর সুস্থতার ক্ষেত্রে সরকারের সহযোগিতা, পাশে থেকে প্রয়োজনীয় সবকিছু করারও আহ্বান জানিয়েছেন দেশের বরেণ্য সাহিত্যিকরা। গতকাল আমাদের অর্থনীতিকে তারা জানান, শওকত আলী তার সময়ের প্রধান লেখকদের একজন। বাংলার প্রাকৃতজনদের ঐতিহ্য নির্মাণ করে তিনি বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন যা সাহিত্যে তাকে একটা স্থায়ী আসন দিয়েছে। তারা আশা করছেন অসুস্থ শওকত আলী সুস্থ হবেন। ফিরে আসবেন সাহিত্য রচনায়।
শওকত আলীর সাহিত্যকে মূল্যায়ন করতে গিয়ে কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক বলেন, শওকত আলী বেশকিছু উপন্যাস লিখেছেন। গল্পসহ অন্যান্য লেখাও তিনি লিখেছেন। এসব লেখা মোটামুটিভাবে নাম করেছে। তিনি ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’ বলে একটি বিখ্যাত উপন্যাস লিখেছেন। সাহিত্যে তিনি অনেকগুলো স্থায়ী কাজ করে যাচ্ছেন।
তিনি বলেন, শওকত আলী আর আমি প্রায় একইসঙ্গে প্রবেশ করেছিলাম। সেদিক থেকে আমরা ভীষণ সহযোগী, পাশাপাশি। তিনি সম্ভবত আমার চেয়ে দুতিন বছরের বড়ও হতে পারেন। আমাদের মধ্যে মিল একটাইÑ নাগরিক জীবন নিয়ে আমরা মাথা ঘামাইনি। কারণ নগরগুলোকে আমাদের পক্ষে নগরের মর্যাদা দেওয়া অন্তত সম্ভব নয়। যারা বিদেশে গেছে তারা তা জানে। সেজন্য আমাদের মনোনিবেশ হয় পুরো দেশ। বাংলাদেশের গ্রামীণ মানুষ, গ্রামীণ সংস্কৃতি ইত্যাদি। এটা আমার ক্ষেত্রে যেমন হয়েছে, শওকত আলীর ক্ষেত্রেও তা হয়েছে। আমাদের বিষয়বস্তু বা যেদিকে যেতে চাই সেটাও বেশ কাছাকাছি। সেজন্য শওকত আলীর সঙ্গে আমার একটা আত্মিক যোগাযোগ সব সময় থেকে গেছে।
তিনি আরও বলেন, কপাল খারাপ তারÑ স্মৃতিভ্রম হয়ে গেছে এ বয়সে। সেটা একটা মারাত্মক ট্র্যাজিক। যার স্মৃতিভ্রম হয়েছে তার কিছু না, তিনি তো মনেই করতে পারছেন না। কিন্তু আমরা যারা তাকে চিনি, সচেতন মানুষ, তাদের জন্য খুব কষ্টদায়ক। তিনি শতবছর বেঁচে থাকুন। সুস্থ হোন, স্মৃতিতে ফিরুন, কর্মোদ্যম ও সৃর্ষ্টিক্ষমতাও ফিরে পানÑ এটাই আমাদের কামনা।
কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন বলেন, বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কথাসাহিত্যিক শওকত আলী। তিনি অস্স্থু, এটা আমাদের জন্য বড় ধরনের বেদনার। শারীরিক অসুস্থতা প্রকৃতির নিয়ম, এটা মানতে হয়। কিন্তু তিনি যে সাহিত্যকর্ম রচনা করেছেন, বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন সেই জায়গা থেকে বলতেই হয় যে, শওকত আলী আমাদের সেই মানুষ যিনি জীবনকে দেখেছেন এক অসাধারণ আলোয়। যে আলোর মধ্যে প্রতিফলিত হয়েছে দেশ, মাটি, মানুষ।
তিনি বলেন, শওকত আলী এবং তার ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’ আমাদের সাহিত্যে একটা চিরস্থায়ী সম্পদ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। তিনি যে পটভূমিতে এই উপন্যাসটি লিখেছেন, যে ঐতিহ্যের নবায়ন করেছেন, যেভাবে উপন্যাসের অনুসঙ্গ এসেছেÑ আমরা মনে করি আমাদের সাহিত্যকে প্রবলভাবে আলোড়িত করেছে। সেই আলোড়নের মধ্যদিয়ে আমরা আমাদের নিজস্ব পথযাত্রাকে তরুণদের পরামর্শ দিতে পারি। তার ত্রয়ী উপন্যাস আমাদের রাজনৈতিক ও স্বাধীনতার প্রেক্ষাপটে একটি বড় কাজ।
তিনি আরও বলেন, আমাদের সকলের একটা সম্মিলিত দায়িত্ব থাকা উচিত যে, এ ধরনের বড় লেখকদের মূল্যায়নের পরিসরটা চারদিকে ছড়িয়ে দেওয়া। এতে তাকে যেমন সম্মানিত করা হবে, তরুণ প্রজন্মকেও জানানো যাবে তার সাহিত্যের ঐতিহ্য সম্পর্কে।
লেখক, গবেষক অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক বলেন, গল্প, উপন্যাসসহ নানাদিক দিয়ে শওকত আলী অন্যদের থেকে ভিন্ন। তরুণ বয়সেই মাকর্সবাদী আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গেও তার যোগাযোগ ছিল। তবে লেখক হিসেবে তার স্বাধীন চিন্তাশীলতার প্রকাশ আছে। তার প্রথমদিকের গল্পে আমাদের সামাজিক অবক্ষয়ের চিত্র সুন্দরভাবে চিত্রিত হয়েছে। পাঠকের মনে ধারণার সৃষ্টি হয় এই অবক্ষয়ের ধারা থেকে আমাদের মুক্ত হতে হবে। পরবর্তীকালে তিনি ঐতিহাসিক উপন্যাস লিখেছেন। সবচেয়ে বিখ্যাত হয়েছে, ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’।
তিনি বলেন, ধর্ম নিয়ে যে বিতর্ক তা থেকে জাতিকে তিনি উদ্ধার করতে চেয়েছেন। ধর্মনিরপেক্ষতা এবং রাষ্ট্রধর্ম ইসলামÑ এই বিতর্কে জাতির কোনো কল্যাণ নেই, নেই মানুষের কোনো কল্যাণ। এর মধ্যদিয়ে সত্যের সন্ধান পাওয়া যাবে না। এই কথাও তিনি উপন্যাস ও গল্পের মাধ্যমে বলেছেন। তার লেখা সম্পর্কে অনেক আলোচনা হওয়া দরকার। আলোচনার মধ্যদিয়ে তার চিন্তা-চেতনা উপলব্ধি করা দরকার। আমাদের সাহিত্য তার চিন্তার ধারা ভবিষ্যতে নতুন দিগন্তের দিকে যেতে পারে।
তিনি আরও বলেন, আমাদের সমাজে যাদের সম্মান পাওয়া উচিত নয়, তাদেরকে সম্মানিত করা হয়। প্রকৃতপক্ষে যাদের সম্মানিত করা উচিত, যারা অনুপ্রাণিত হলে জাতি উপকৃত হবে সেই মানুষদের সম্মানিত করা হয় না। শওকত আলীর প্রতি, তার লেখা ও চিন্তা নিয়ে অনেক বেশি মনোযোগ দেওয়া দরকার ছিল। সেটা কি আমরা করেছি?
কথাসাহিত্যিক জাকির তালুকদার বলেন, বাংলাদেশে পাকিস্তান আমলে অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ, প্রগতির ধারক যে অল্প কয়েকজন মানুষ ছিলেন, লেখক ছিলেন তাদের মধ্যে শওকত আলী অগ্রগণ্য। নিপীড়িত মানুষ বলতে আমরা যাদের বোঝাই, নিপীড়িত মানুষজনদের নিয়ে তো অনেকেই কল্পকাহিনী তৈরি করেন, কিন্তু জীবনের সঙ্গে যে ঘনিষ্ঠতা, জীবনকে চেনা, তাদের জীবনের স্বপ্ন, তাদের বেঁচে থাকার যে তাৎপর্য…। আমরা অনেকেই মনে করি, নিপীড়িত জীবনের কোনো অর্থ নেই, তবু তারা বেঁচে আছে। কিন্তু আসলে যে নিম্নবর্গের মানুষ তাদের বেঁচে থাকার মধ্যদিয়ে তাদের জীবনের অর্থ খুঁজে নেয় এ ব্যাপারটা শওকত আলীর আবিষ্কার। পরবর্তীতে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের হাতে তার আরও বেশি পরিণতি, সেটা আমরা পাই।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে আজকে আমরা যারা সাহিত্যচর্চা করছি, গল্প-উপন্যাস লিখছি, তার যে মানচিত্র আছে, নতুন পথ সৃষ্টি করতে গেলে তাদের পথ ধরে হেঁটে গিয়ে তারপর সেটা করতে হবে। আজকেও যে লিখতে শুরু করেছে তার জন্যও শওকত আলী অপরিহার্য।
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের সাহিত্যকর্ম এমন একটা ব্যাপার যেখানে ধীরে ধীরে রাষ্ট্রসমাজ পুরো সাহিত্য এবং গভীর চিন্তামূলক যেকোনো কাজকেই একপ্রান্তে ঠেলে দিচ্ছে। সমাজ ও রাষ্ট্রের এখন যে অবস্থা তাতে সাহিত্য জিনিসটাই গৌণ হয়ে গেছে। অপ্রয়োজনীয় করে তোলা হয়েছে। এবং এটাকে একটা গ্ল্যামারবিহীন জগত আমরা বলতে পারি। রাষ্ট্র কাউকে একটা পদক অথবা কোনো একটা সম্মাননা দেয়। বা কোনো একটি সংগঠন একটি সম্মাননা দেয়। এভাবে সাহিত্য মূল্যায়ন হয় না। সাহিত্য মূল্যায়নের জায়গা হচ্ছে সমাজের সর্বস্তরের শিক্ষার্থীদের মধ্যে, মানুষদের মধ্যে সাহিত্যিকদের যদি পরিচিত করে তোলা যায়, সাহিত্য পাঠের জন্য আগ্রহী করে তোলা যায় তাহলে সেটাকেই বলা যেতে পারে সাহিত্যিকদের সত্যিকারের মূল্যায়ন। সম্পাদনা : হাসিবুল ফারুক চৌধুরী