তাবলীগ ও বিশ্ব ইজতেমা: দ্বীন শেখার পাঠশালা
উবায়দুল হক খান
বিশ্ব ইজতেমা। মুসলমানদের দ্বিতীয় বৃহত্তম মহাসমাবেশ। আমাদের জন্য এক অনন্য শিক্ষা। হজের এটি পৃথিবীর বৃহত্তম সমাবেশ হওয়া সত্ত্বেও তা নিয়ন্ত্রণের জন্য কোন সরকারী বাহিনীর প্রয়োজন হয় না। এখানে সকলেই ভাই ভাই, কেউ কারো প্রতিপক্ষ নয়। কেউ কারো বিরোধী নয়। কেউ কারো প্রতিযোগিও নয়। দীনের মেহনত ও ফিকিরের এক মহান নমুনা দাওয়াত ও তাবলীগ। মহান আল্লাহ তার এক খাস বান্দা মাওলানা ইলিয়াস (রহ.)-কে দিয়ে ১৯১০ সালে ভারতের এক জনবিরল অঞ্চল মেওয়াত থেকে এ কাজ চালু করিয়েছেন। এ মেহনত এখন সাড়া বিশ্বে ছড়িয়ে পরেছে। ১৯৪৪ সালে মাওলানা ইালিয়াস (রাহ.)-এর ইন্তেকালের পর তার ছেলে মাওলানা ইউসুফ (রাহ.) এ কাজ চালিয়ে যান। দিল্লির নিজাম উদ্দীন বাংলোওয়ালি মসজিদ হয় তাবলীগ জামাতের বিশ্বকেন্দ্র। তারপর আলেম-উলামাদের মাশোওয়ারাক্রমে ১৯৪৬ সালে বিশ্ব ইজতেমা সর্বপ্রথম অনুষ্ঠিত হয় বাংলাদেশের তাবলীগ জামাতের মারকাজ রাজধানীর কাকরাইল মসজিদে। অতপর সর্বশেষে ১৯৬৬ সাল থেকে টঙ্গীর তুরাগ নদীর তীরে বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। এখানে ঈমান-আমল ও আখলাক-চরিত্রের যে নমুনা পেশ করা হয়, খুব কম জায়গায়ই তার দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। আল্লাহপ্রেমিদের এ সমাবেশ বিশ্ব ইজতেমাকে যদি গভীরভাবে দেখা হয়, তাহলে বুঝে আসেÑ এটি একটি ইবাদতখানা, জিকিরের মাঠ, আমল-আখলাকের মিশন, আখেরাত চিন্তার অনুশীলন, দীনি বিষয়াবলী ফিকিরের মারকায, ভ্রাম্যমান মাদরাসা। আর এ জন্যই এই বিশ্ব ইজতেমা সারা বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। একটু চিন্তা করলে অবাক হতে হয় এজন্য, দুনিয়ার মানুষ যখন মারামারি, হানাহানি, ধবংসাত্মক কার্যকালাপ, লুটপট, খুন-খারাবি, রাজাহানি, জুলুম-নির্যাতন, শোষণ ও নিপিড়নে লিপ্ত এবং বিজাতীয় নগ্ন সংস্কৃতির অন্ধ অনুকরণে মত্ত, তখনই এ অশান্ত পৃথিবীকে শান্ত করতে মানুষের ইসলাহের এক মহান ফিকির নিয়ে চালু হয়েছে দাওয়াতে তাবলীগ। যার বাস্তব প্রমাণ হলো, কেউ যখন এ মেহনতের মুরোব্বিদের সামনে বসে, দুনিয়ার মায়া-মহব্বত তখন অন্তর থেকে কমতে থাকে এবং আখেরাতের ফিকির বাড়তে থাকে।
দীনের এ পবিত্র কাফেলা যখন হাঁড়ি-পাতিল ও বিছানা-বালিশ নিয়ে গ্রাম থেকে শহর ও দেশ-দেশান্তরে চলেন, তখন দৃষ্টি নিচু অবস্থায় মুখে আল্লাহর জিকির থাকে, আমীরের নির্দেশ মানার দৃঢ় সংকল্প থাকে। শীত-গরমের কষ্ট, ক্ষুধা ও পিপাসার কোন চিন্তা ও চিহ্ন তাদের চেহারায় প্রকাশ পায় না। শহর-বন্দরে গিয়ে যখন দীনের এ দাওয়াতি কাফেলা বের হয়, দুনিয়ার চাকচিক্য ও বস্তুর আকর্ষণ তাদেরকে কোনভাবেই আকৃষ্ট করতে পারে না। এ কাফেলার কোন অংশ যখন দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে যায়, তখন সে এলাকার অচেনা-অজানা লোকদের সাথে এমন আচরণ করেন, যেন তারা বহুদিনের পুরনো বন্ধু।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে, তাবলীগ জামাত এ যুগের বিশেষ হেদায়াতি কাফেলা। পথহারা মানুষদের সুপথের সন্ধান দান ও আল্লাহর সঙ্গে জুড়ে দেয়ার মহান দায়িত্ব আঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছেন তারা। বিশ্বব্যাপী ঈমান ও ইয়াকীনের অপূর্ব মেহনত চালিয়ে যাচ্ছেন তারা। আর গোটা পৃথিবীতে তাদের মহৎ কর্মধারার পরিচালনা প্রণয়ণের মহা মিলনকেন্দ্রই হচ্ছে টঙ্গীর বিশ্ব ইজতেমা। সবকিছু মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে হওয়ার ইয়াকীন ও আল্লাহর হুকুম ব্যতীত কোন কিছুর না হওয়ার তালীম দেয়া হয় তাবলীগ জামাতে। এখানে আরো শিক্ষা দেয়া হয়, আসমান-জমীনের সকল কার্যক্রম মহান অদৃশ্য শক্তির নিয়ন্ত্রণে চলছে। মাখলুকাতের সবকিছু আল্লাহর একত্ববাদের সাক্ষ্য বহন করেছে। মান-অপমান বাদশাহী-ফকিরী সবই তার হাতে। তিনি ইচ্ছা করলে মুহূর্তে বাদশাহকে ভিখারী আর পথের ভিখারীরকে সম্মানের সর্বোচ্চ আসনে সমাসীন করেন। লেখক : মুঈনে মুফতী, জামিআ সাবিলুর রাশাদ, গাজীপুর।