রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তন ও অংকের ফাঁক কাকন রেজা
রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তন বিষয়ে লিখতে চেয়ে ছিলাম। কিন্তু ‘সাপ্তাহিক’ সম্পাদক গোলাম মোর্তোজা তার জন্য কিছু ফেলে রাখেননি। প্রত্যাবর্তন প্রক্রিয়ার খুটিনাটি অনেক কিছুই ঠাঁই পেয়েছে“তালগাছ’ মিয়ানমারের” শিরোনামে তার লেখায়। তবু বলি, রোহিঙ্গা ‘গণহত্যা’ শুধুমাত্র প্রতিহিংসাবশত‘ এথিনিক ক্লিন্সিং’ নয়। হ্যাঁ, ধর্মগতভাবে বৌদ্ধ এবং স¤প্রদায়গতভাবে মগ’ দের না হয় অনৈতিক প্রতিহিংসা রয়েছে ‘স¤প্রদায়ে রোহিঙ্গা’ এবং ‘ধর্মেমুসলিম’ দের প্রতি। কিন্তু নির্মম এই ‘রুট আউট’ প্রক্রিয়ার কী এটুকুই সব? তাই যদি হতো তাহলে রাখাইনের পোড়া গ্রামগুলিতে অর্থনৈতিক অঞ্চলগড়ার তাড়া-হুড়াকেন? চীন আর ভারতের কেন ‘বাঘেমোষে একঘা টেপানি খাওয়া’র মতন রোহিঙ্গা ইস্যুতে একপাত্রে পান করা? জাতিগত নিধন প্রক্রিয়ার সাথে এ প্রশ্নগুলোর উত্তরও জরুরি। চীন বা ভারত তাদের স্বার্থ দেখবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এই দুই পরাশক্তির মাঝে আমাদের স্বার্থটা কী? অনেকে বলেন, দুইটায় দুধ খায়, একটা দেইখাই লাফায়’ এমন কথা। কিন্তু এটাকী শুধু ‘লাফানি’র বিষয়, নাকি ‘লাফানি’টা ‘ক্যামোফ্লেজ’ মাত্র? আশংকা ছিল, প্রকাশও করেছিলাম একটি লেখায়। বলেছিলাম, এই যে তুরস্কের আবাসন নির্মান বিষয়ক আলাপ, আলাদা চরেনিবাস তৈরীর পরিকল্পনা, বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে ঋণ নেয়ার কথা, এসবতো প্রত্যাবর্তনের ক্ষেত্রে ভালো লক্ষণ নয়।
বাংলাদেশ মিয়ানমার দ্বিপাক্ষিক সম্মতিপত্রে স্বাক্ষর করেছে। এখানে কোন তৃতীয় পক্ষ নেই। অবস্থা দৃষ্টে বাংলাসিনেমার ‘আমাদের দুজনের মধ্যে তৃতীয়জনের প্রয়োজন নেই’, প্রেমিক-প্রেমিকার এমন সংলাপ মনে পড়ে যায়। কিন্তু সম্মতি পত্রকরার সময় একান্তই ভেবে দেখা দরকার ছিল, চীন-রাশিয়া-ভারত এই তিন শক্তি সরাসরি মিয়ানমারের সাথে সংহত। বিপরীতে আমাদের সংহতিতে কারা। অবশ্য যারা চুক্তি করেছেন তারা আমাদের মতন বোকাসোকা নন, তারা নিশ্চয়ই তাদের দায়িত্ব বোঝেন, চুক্তির ভেতরে-বাহিরে দেখেই সম্মত হয়েছেন। তবে কোন কোন দুষ্টেলোক বলছেন, এই সমস্যাটি তৈরি এবং তা বিতারণ ও আশ্রায়ন বিষয়ক বোঝাপড়ার মাধ্যমেই। এ প্রসঙ্গে উঠে আসছে সামনে আমাদের নির্বাচন, আন্তর্জাতিক রাজনীতির সম্পর্কের রসায়ন এবং সাথে রোহিঙ্গা অনুষঙ্গ মিশে থাকার মত বিষয়ও। এসব হয়তো কথার কথা, সত্যি নয় এবং আমরাও তাই চাই। কিন্তু শংকা জাগায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তন প্রশ্নে গোলাম মোর্তোজার দেয়া হিসাবের বিষয়টি। সামাজিক যোগাযো মাধ্যমে এ বিষয়ে নিজ লেখার লিংকের সাথে তিনি প্রত্যাবর্তনের একটি সংক্ষিপ্ত অথচ সার্বিক সংখ্যা চিত্রযোগ করেছেন। আর তাতেই দৃশ্যমান হয়েছে ‘শুভংকরের ফাঁকি’ রবিষয়টি। স্বাক্ষরিত সম্পতি পত্রে বলা হয়েছে দু’বছরের মধ্যে সবরোহিঙ্গা ফেরত যাবে বা নেয়া হবে। কিন্তু প্রতিসপ্তাহে রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনের সংখ্যাহবে ১৫’শ। তাহলে দু’বছরের মোট ১০৪ সপ্তাহে রোহিঙ্গা ফিরবে ১ লাখ ৫৬ হাজার। ফাঁকি বা ফাঁকটা এখানেই। জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সবকিছু দেখভাল করে ‘ইউ এন এইচ সি আর’। এদের মতে বাংলাদেশে রোহিঙ্গার সংখ্যাপ্রায় ১০ লাখের মত। ২০১৬ সাল থেকে এখন পর্যন্ত আসা রোহিঙ্গার সংখ্যাই ৬ লাখ ৫৫ হাজার। অথচ দু’বছরে ফেরত যাবে হিসাবঅনুযায়ী ১ লাখ ৫৬ হাজার। তারপর? হয়তো তারপরেও ভেবে রেখেছেন সংশিøষ্টরা। হয়তো আবার সম্মতিপত্র হবে, আবার দু’বছরে দেড় বা দুই লাখ ফেরত যাবেন। বাকীদের ফেরত যেতে ক’বছর লাগবে তা ভবিষ্যতই বলে দেবে। সা¤প্রতিক হিসাব বলে একদশকেরও বেশি। লাগুক, তবু তারা ফিরে যাক নিজ বাসভ‚মে, এটাই মানুষের প্রার্থনা হওয়া উচিত। কিন্তু এই প্রার্থনাতেও একটু ফাঁক থেকে যায়। সেটা হলো, আমরাতো আর তাদের ডেকে আনিনি, তাদের আশ্রয় দিয়েছি মাত্র। দীর্ঘদিন আমাদের দেশে তাদের পরিপালনে আমরা যে ক্ষতির সম্মুখিন হলাম তা পূরণ করবে কে? আর এই ক্ষতিপূরণের বিষয়টি যদি সঠিক উলেøখিত না হয় তাহলে দুষ্টলোকের ‘বোঝাপড়া’ বিষয়ক সেই গপ্পের মালায় আরো ফুলযুক্ত হবে। আর সেই ফুলেরমালা, কাঁটার মালার চেয়েও হতে পারে অস্বস্থিকর ও যন্ত্রণাময়।
হতে পারেতো? ফুটনোট : গণমাধ্যম জানিয়েছে গত ৩ জানুয়ারী থেকে মিয়ানমারের কাচিন ও শানরাজ্যে কাচিন ও তাং বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সাথে সংঘর্ষে জড়িয়েছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। এই দুই রাজ্য থেকেও পালাচ্ছে স¤প্রদায় দুটির হাজার হাজার মানুষ। কাচিনের উত্তর ও পূর্বপাশ্বের্ চীন আর পশ্চিমে ভারত। শানের পার্শ্বেও চীন। ‘তোমারে বধিবে যে গোকুলে বাড়িছে সে’, চিন্তার উপকরণ হিসাবে এ বিষয়টিও ভেবে দেখতে পারেন।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট
সম্পাদনা : গাজী খায়রুল আলম