৫৩তম বিশ্ব ইজতেমার দ্বিতীয় পর্বের আখেরি মুনাজাত আজ আল্লাহু আকবার ধ্বনিতে মুখরিত তুরাগ তীর
গাজীপুর প্রতিনিধি, মো. মিলটন খন্দকার : বয়ান আর ধর্মীয় ভাবগম্ভীর পরিবেশে টঙ্গীর তুরাগ তীরে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম জমায়েত তিন দিনব্যাপী বিশ্ব ইজতেমার দ্বিতীয় পর্বের দ্বিতীয় দিন অতিবাহিত হয়েছে। শনিবার বাদ ফজর থেকে বাংলাদেশের মাওলানা মোহম্মদ হোসেন তাবলিগের ৬ উসুলের (মৌলিক বিষয়ে) ওপর বাংলা ভাষায় বয়ান করেন। বয়ানকালে তিনি পবিত্র কুরআন-হাদিসের আলোকে উদাহরণ তুলে ধরেন। বাদ জোহর বয়ান করেন সোমালিয়ার মাওলানা শেখ ইসমাইল, বাদ আসর বাংলাদেশের মাওলানা রবিউল হক এবং বাদ মাগরিব বাংলাদেশের হাফেজ মাওলানা জোবায়ের। এসময় মুসল্লিরা চাদর-কম্বল মুড়িয়ে মনোযোগের সঙ্গে ধর্মীয় বয়ান শুনছেন, তছবিহ গুনছেন আর জিকির আজকার করছেন।
শনিবারের বয়ানকারী : ইজতেমার প্রথম দিনের ন্যায় দ্বিতীয় দিনেও ধর্মপ্রাণ মুসল্লিরা জিকির আজকার ও ইবাদত বন্দেগীতে মশগুল ছিলেন। তাদের সার্বক্ষণিক ইবাদতে টঙ্গী এখন এক পবিত্র পুণ্যভূমিতে পরিণত হয়েছে। শনিবার বাদ ফজর থেকে এশা পর্যন্ত তাবলিগ জামাতের আলেমগণ ঈমান, আমল, আখলাক ও দ্বীনের পথে মেহনতের ওপর আমবয়ান করেন। শনিবার বাদ ফজর বয়ান করেন বাংলাদেশের মাওলানা মোহম্মদ হোসেন। বাদ জোহর সৌদি আরবের শেখ ইসমাইল ও বাংলাদেশের মাওলানা মো. জাকির হোসেন। বাদ আসর বাংলাদেশের মাওলানা রবিউল হক এবং বাদ মাগরিব বাংলাদেশের হাফেজ মাওলানা জোবায়ের বয়ান করেন বলে জানিয়েছেন বিশ্বইজতেমার মুরব্বি ইঞ্জিনিয়ার মো. গিয়াস উদ্দিন।
রোববার সকালে আখেরি মোনাজাত : বিশ্বইজতেমার মুরব্বি মো. মাহফুজ জানান, এবারের বিশ্বইজতেমার দ্বিতীয় পর্বেও রোববার আখেরি মোনাজাত পরিচালনা করবেন বাংলাদেশের কাকরাইলের মাওলানা জোবায়ের। এদিন আরবি ও বাংলায় সকাল ১০-১১টার মধ্যে অনুষ্ঠিত হবে আখেরি মোনাজাত। ইতোপূর্বে মাওলানা জোবায়ের তাবলীগের প্রয়াত বিশ্ব আমির মো. জোবায়রুল হাসান এবং মাওলানা সা’দের বয়ান বিশ্ব ইজতেমায় আগত বাঙালিদের বাংলায় অনুবাদ করে শুনাতেন। একই ময়দানে গত ১২ জানুয়ারি শুরু হয় বিশ্ব ইজতেমার প্রথম দফা। প্রথম দফায় ঢাকার একাংশসহ ১৪ জেলার মুসল্লিরা অংশ নেন। ১৪ জানুয়ারি আখেরি মোনাজাতের মধ্যে দিয়ে শেষ হয়েছিল প্রথম দফা।
ইজতেমা ময়দানে আসতে মুসল্লিদের ঢল : আজ রোববার আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে শেষ হবে ২০১৮ সালের অনুষ্ঠিত দুই পর্বের বিশ্ব ইজতেমা। আর আখেরি মোনাজাতে শরিক হতে দ্বিতীয় দিনেও দেশ-বিদেশের বিভিন্ন স্থান থেকে মুসল্লিরা ইজতেমা ময়দানের দিকে ছুটে আসছেন। মোনাজাতের আগ পর্যন্ত মুসল্লিগণের এ ঢল অব্যাহত থাকবে বলে জানিয়েছে ইজতেমা কর্তৃপক্ষ।
বিশেষ করে আখেরি মুনাজাতে শরিক হতে রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন থানাসহ গাজীপুর ও আশপাশের এলাকার অগণিত মুসল্লির ঢল নামবে ইজতেমা অভিমুখে। যা টঙ্গীর তুরাগ তীরে জন সমুদ্রে পরিণত হবে। আয়োজকদের ধারণা, অন্য বছরের তুলনায় এ বছর আবহাওয়া পরিস্থিতি অনুকূলে থাকায় এবার মুসল্লির সংখ্যা অনেক বেশি হবে।
ইজতেমায় দুই মুসল্লির মৃত্যু : টঙ্গী সরকারি হাসপাতালের কন্ট্রোল রুমের দায়িত্বে থাকা সহকারি স্বাস্থ্য পরিদর্শক চিত্তরঞ্জন দাস বলেন, বার্ধক্য জনিত কারনে ও শ্বাসকষ্ট জনিত কারণে আরো দুই মুসল্লীর মৃত্যু হয়েছে। তাদের মধ্যে শুক্রবার রাত সোয়া ১টার দিকে বার্ধক্যজনিত কারণে জামালপুরের ইসলামপুর উপজেলার মোবারক হোসেন ওরফে মোহর আলী (৬৫)। অপরজন শ্বাসকষ্টজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে শনিবার সকাল সোয়া ৬টার দিকে ঢাকার দক্ষিণ কেরাণীগঞ্জ এলাকার ওমার আলীর ছেলে মো. শহীদুল ইসলাম (৫৬) মারা গেছেন। আগে বিশ্বইজতেমায় যোগ দিতে আসা এক মালয়েশিয়ান ও আফ্রিকান নাগরিকসহ পাঁচ মুসুল্লীর মৃত্যু হয়েছিল।
ইজতেমার তাশকিল ও কর্মসূচি : ইজতেমা প্যান্ডেলের উত্তর-পশ্চিমে তাশকিলের কামরা স্থাপন করা হয়েছে। এছাড়া প্রতিটি খিত্তায় তাশকিলের জন্য বিশেষ স্থান রাখা হয়েছে। আল্লাহর রাস্তায় বের হতে আম ও খাস বয়ান, তালিম, তাশকিল, ৬ উছুলের হাকিকত, দরসে কোরআন, দরসে হাদিস ও চিল্লার বিভিন্ন মেয়াদে তালিকাভুক্ত করা হচ্ছে। পরে কাকরাইলের মসজিদের মুরব্বিদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নতুন জামাত তৈরি তাদের দেশের বিভিন্ন এলাকায় দ্বীনের মেহনতে পাঠানো হবে।
৮০টি দেশের চার হাজার বিদেশি মুসল্লী : শনিবার দুপুর পর্যন্ত বিশ্ব ইজতেমার দ্বিতীয় পর্বে জর্ডান, মালয়েসিয়া, সোমালিয়া, লিবিয়া, আফ্রিকা, লেবানন, আফগানিস্তান, ফিলিস্তিন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, তুরস্ক, ইরাক, ইরান, সৌদি আরব, ভারত, পাকিস্তান, ইংল্যান্ডসহ বিশ্বের ৮০টি দেশের প্রায় ৪ হাজার বিদেশি মুসল্লি অংশ নিয়েছেন। এছাড়া দেশের ১৪টি জেলার কয়েক লাখ মূসল্লীরা ইজতেমায় অংশ নিয়েছেন বলে জানিয়েছেন গাজীপুরে জেলা প্রশাসক দেওয়ান মুহাম্মদ হুমায়ুন কবীর।
ইজতেমায় যানবাহন নিয়নন্ত্রণে পুলিশ সুপারের ব্রিফিং : গাজীপুরের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ হারুন অর রশিদ শনিবার সকালে টঙ্গীর আহসান উল্লাহ মাস্টার স্টেডিয়ামে ইজতেমার পুলিশ কন্ট্রোল রুমে এক ব্রিফিংয়ে জানান, আখেরী মোনাজাতের দিন ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের চান্দনা- চৌরাস্তা হতে টঙ্গী ব্রীজ পর্যন্ত কালীগঞ্জ-টঙ্গী সড়কের মাজুখান ব্রীজ হতে স্টেশন রোড ওভারব্রীজ পর্যন্ত এবং কামারপাড়া ব্রীজ হতে মন্নু টেক্সটাইল মিলগেট পর্যন্ত সড়কপথ বন্ধ থাকবে। তবে ভোগড়া বাইপাস মোড় থেকে মুসুল্লীদের নিয়ে ইজতেমাস্থলের দিকে নির্ধারিত সময় পর্যন্ত ১৫টি শ্যাটল বাস চলাচল করবে। এছাড়া ১৯টি বিশেষ ট্রেন চলাচল করবে। আন্ত নগর ট্রেনগুলো টঙ্গী স্টেশনে দুই মিনিট করে যাত্রাবিরতি করবে। শনিবার ২০ জানুয়ারি রাত ১২টা হতে টঙ্গীর নিমতলী রেলক্রসিং, কামারপাড়া ব্রীজ ও ভোগড়া বাইপাস দিয়ে ইজতেমাস্থলের দিকে সকল প্রকার যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকবে। তবে বিকল্প হিসেবে ভোগড়া বাইপাস দিয়ে কোনাবাড়ি ও চন্দ্রা হয়ে এবং বিপরীত দিকে ৩০০ ফুটের রাস্তা দিয়ে গাড়ি চলাচল করবে।
নৌযান চলাচল নির্দেশনা : এছাড়া ২১ জানুয়ারি পর্যন্ত কামারপাড়া সেতু থেকে টঙ্গী সেতু পর্যন্ত তুরাগ নদীতে সকল প্রকার নৌযান চলাচল ও নোঙ্গর বন্ধ থাকবে। প্রয়োজনে নৌযানসমূহ টঙ্গী সেতুর পূর্ব পাশে এবং কামারপাড়া ব্রীজের উত্তর পাসে নোঙ্গর করতে পারবে। নারায়নগঞ্জ ছাড়াও সদরঘাট থেকে ৬টি ওয়াটার বাস টঙ্গী পর্যন্ত মুসুল্লী বহন করবে।
ইজতেমার ইতিকথা : ইজতেমার মুরব্বিদের দেওয়া তথ্যমতে, ১৯৪৬ সালে প্রথম কাকরাইল মসজিদে ইজতেমার আয়োজন শুরু করা হয়। তারপর ১৯৪৮ সালে চট্টগ্রামের হাজী ক্যাম্পে ও ১৯৫৮ সালে নারায়নগঞ্জের সিদ্ধরগঞ্জে ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর লোকসংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় ১৯৬৬ সালে গাজীপুরের টঙ্গীর তুরাগ নদীর তীরে বর্তমান জায়গায় স্থানান্তর করা হয়েছে। পরে সরকারি ভাবে তুরাগ তীরের ১৬০ একর জমি স্থায়ীভাবে ইজতেমার জন্য বরাদ্দ দেয়া হয়। ২০১১ সাল থেকে দুই দফায় বিশ্ব ইজতেমার আয়োজন করা হয়। স্থান সংকুলান না হওয়া, অংশগ্রহণকারীদের বিভিন্ন অসুবিধা ও নিরাপত্তার বিষয়টি মাথায় রেখে এ আয়োজন করা হয়।