মিয়ানমার সেনাবাহিনী নিজ দেশের জনগণের বিরুদ্ধেই লড়ছে
লিহান লিমা : ৭৬ বছর আগে রক্তবিন্দুর যে প্রতিজ্ঞা দিয়ে মিয়ানমারের আর্মির জন্ম হয়েছিল এখন আর তার কিছুই অবশিষ্ট নেই। লাখ লাখ রোহিঙ্গা মুসলিমকে মাতৃভূমি ত্যাগে বাধ্য করা ছাড়া তার আর নতুন কোন কিছুই করতে পারে নি।
১৯৪১ সালে ব্যাংককে ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা পাওয়ার জন্য মিয়ানমারের ৩০ জন তরুণ মিলে এই বাহিনী গঠিত হয়। এই সময় আনুগত্যের প্রমাণ দিতে প্রত্যেকে তার শরীর থেকে সিরিঞ্জ দিয়ে রক্ত বের করে রুপোলি রঙের বোলে জমা করে সবাই তা পান করে। এই সদস্যরাই ১৯৪৮ সালে মিয়ানমারকে স্বাধীন করে। ধারণা করা হয়েছিল স্বাধীনতা শান্তি আনবে, কিন্ত তা ছিল ক্ষণিকের আত্মতৃপ্তি এবং পরবর্তী সাত দশক ধরে এক সময় দেশের স্বাধীনতার নেতৃত্ব দেয়া এই বাহিনীই দেশের মানুষের সঙ্গে লড়াই করছে।
তাতমাদাও খ্যাত এই সেনাবাহিনী ১৯৬২ সালে মিয়ানমারের শাসন ক্ষমতা দখল করে। ক্ষমতাকে করায়ত্ত করার জন্য ১৯৮৮ সালে ৩ হাজার গণতন্ত্রকামী বিক্ষোভকারীকে হত্যা করে এবং ২০০৭ সালে সাফ্রোন বিপ্লবকেও নীল নকশার ধোঁয়ায় আড়ালে দমন করে। মূল্যবান রতœপাথরের খনি, সেগুন গাছের বনাঞ্চল ও অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদ দখল করে মিয়ানমারের এক এক সেনা কর্মকর্তা হয়ে উঠেছে ধনকুবের, সেই সঙ্গে সংখ্যালঘুদের ওপর চালানো রক্তের হোলিখেলায় বাস্তুহারা হয় লাখ লাখ মানুষ।
ওয়াশিংটনের ন্যাশনাল ওয়ার কলেজের প্রফেসর জেসারি আবুজা বলেন, ‘জনগণের হৃদয় জয় করার মত কোন শব্দের ঠাঁই নেই মিয়ানমার আর্মির অভিধানে। তাতমাদাও ভয় ছড়ানোর সংস্কৃতিকে ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে, দিনের শেষে সেই ভয়কে সম্প্রসারিত করতে এমন কিছু নেই যে তারা করে নি।’
মিয়ানমারের সেনাবাহিনী নিজকে তার জনগণের রক্ষাকর্তা বললেও নিরস্ত্র জনসাধারণকে হত্যা, আটককৃতদের নির্যাতন ও মৃত্যুদ-, ধর্ষণ, শিশুদের সেনাবাহিনীতে নিয়োগ, নাগরিকদের জোরপূর্বক ল্যান্ড মাইনের ওপর হাঁটতে বাধ্য করার মত জঘন্য কৃতকর্মের দীর্ঘ ইতিহাস আছে তাদের।
দীর্ঘদিন ধরে সামরিক শাসনের যাঁতাকলে পিষ্ট মিয়ানমার ২০১০ সালে নির্বাচনের অনুমোদন পায়। প্রশাসন, পররাষ্ট্র ও অর্থনীতিতে রাজনীতিক নেতাদের অংশগ্রহণের অনুমোদন দেয়া হয়। এছাড়া জনগণের ইন্টারনেট ব্যবহার ও ইচ্ছেমত মোবাইল ফোন ক্রয়ের অনুমতি দেয়া হয়। কিন্তু যেখানে দ্বন্দ্ব ও সংঘাত সৃষ্টিই তাতমাদাওয়ের ক্ষমতায় টিকে থাকার ও ধনী হওয়ার একমাত্র চাবিকাঠি সেখানে শান্তির স্থান কোথায়।
তবে এই পরিবর্তনের ফলে দীর্ঘদিন ধরে মিয়ানমারের ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা জারি করা যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপিয় ইউনিয়ন অবরোধ তুলে নেয়। বর্হিবিশ্বের বিনিযোগ আকৃষ্ট করে অর্থনৈতিক সুবিধা অর্জন করে মিয়ানমার।
কিন্তু ২০০৮ সালের সংবিধান অনুযায়ী তাতমাদাও বা সেনাবাহিনী পুলিশ ও সীমান্ত রক্ষী বাহিনী, পার্লামেন্টের এক চতুর্থাংশের ওপর কর্তৃত্ব বজায় রাখে। সেই সঙ্গে চলতে থাকে সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন। ২০১১ সালে মিয়ানমারে গণতান্ত্রিক সরকার দায়িত্ব নিলেও দেখা যায়, প্রতি মাসে বিদ্রোহীদের সঙ্গে সেনাবাহিনীর প্রায় ১০টি সশস্ত্র সংঘর্ষ হচ্ছে। রাজনৈতিক নেতাদের কাছে এই অস্থিতিশীলতা নিয়ন্ত্রণের সামর্থ্য থাকলেও তা বেড়েই যাচ্ছে এবং ২০১৭ সালে এটি সর্বোচ্চ মাত্রায় পৌঁছায়। জাতিসংঘের হিসেবে এই সংঘর্ষের কারণে ৩ লাখ ৪০ হাজার রোহিঙ্গা মিয়ানমার ও থাইল্যান্ডের শিবিরে বসবাস করছে এবং গত ১৫ মাসে ৭ লাখ ৩৭ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে। অন্যদিকে এই সংঘর্ষের সুযোগে মিয়ানমারের আর্মি সংঘাত র্পূণ অঞ্চলগুলো থেকে প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ করছে।
২০১৫ সালে লন্ডনভিত্তিক দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা গ্লোবাল উইটনেসের প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী বাহিনী ও সেনা বাহিনীর সংঘাতের ফলে অস্থিতিশীল কাচিন রাজ্য থেকে সেনাবাহিনী গত এক দশকে ১২০ বিলিয়ন ডলারের রতœপাথর আহরণ করে। যা আধুনিক ইতিহাসে প্রাকৃতিক সম্পদ কেলেঙ্কারির সবচেয়ে বড় ঘটনা।’ এছাড়া সহিংসতায় ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলগুলোতে তাতমাদাওয়ের সোনা, রুবি, কপার এবং টিম্বার বাণিজ্য আছে। উপজাতী গোষ্ঠিগুলো জানায়, সেনাবাহিনী জমি দখল করে সেখানে হাইডোইলেকট্রিক বাঁধ স্থাপন করে এবং সেখান থেকে বিদ্যুত উৎপাদন করে চীন রপ্তানি করা হচ্ছে। তাতমাদাও মিয়ানমারের দুইটি বিখ্যাত অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান মিয়ানমার ইকোনমিক হোল্ডিং লিমিটেড ও মিয়ানমার ইকোনমিক কর্পোরেশন-এর মালিক।
অং সান সু চীর দীর্ঘদিনের পরমর্শক ইউ উইন হাইথিন বলেন, ‘আর্মি শান্তি চায় না।’ ১৮ বছর ধরে সেনাবাহিনীতে থাকা হাইথিন সরকারবিরোধীতার কারণে ২০ বছর কারাবাস করেছিলেন। ২০১৩ সালে সাবেক জেনারেল থেইন সেইন প্রথম নাগরিক নেতা হিসেবে প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেয়ার পর তিনি বলেন, ‘তিনি ক্ষমতা গ্রহণ করে আর্মিদের চুপ থাকার আহ্বান জানালেন কিন্তু তারা থামল না। কারণ মিয়ানমারে আর্মিরা স্বাধীন এবং কেউই তাদের প্রভাবিত বা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। তারা কারো কথাই মানে না।’ নিউইয়র্ক টাইমস।