শিব পূজার মাহাত্ম্য
নিতাই চাঁদ তালুকদার এফ.সি.এ
লিঙ্গ শব্দের আমরা শুধু একটি অর্থ জানি তা হলো জননেন্দ্রিয় এবং ব্যকরণগত অর্থ হলো পুংস্তত্ব বা স্ত্রীত্ব জ্ঞাপক অর্থ। লিঙ্গ শব্দের যে আরও অর্থ হতে পারে তার কোনো চিন্তা আমরা করি না। লিঙ্গ শব্দের আরেকটি অর্থ হলো সূক্ষ দেহ। এই দেহটিতে যুক্ত আছে পাঁচটি জ্ঞানেন্দ্রিয়, ৫টি কর্মেন্দ্রিয় এবং ৫টি প্রাণ অপান বায়ু, মন ও বুদ্ধি- মোট ১৭টি অবয়ব যুক্ত দেহ। সকল সৃষ্টিরই সূক্ষ শরীর আছে। আমাদের যখন মৃত্যু হয় তখন জীবাত্মা সূক্ষ শরীরে বিচরণ করেন এবং পুনরায় দেহ ধারণ করেন। শিব রুদ্র ও মহাদেব এই তিনটি নামই আমাদের মধ্যে বেশি পরিচিত। যে সূক্ষ শরীরকে আমরা লিঙ্গ বলে পূজা করি তা সৃষ্টির সূক্ষ শরীর প্রকৃতিতে বীজ বপনরূপ সূক্ষ বিষয়টিকে দেখানো হয়েছে। এখানে স্ত্রী-পুরুষের মিলিত অঙ্গ নয়। বিশেষভাবে লক্ষ্য করলে তা অনুধাবন করা যায়। আমাদের প্রচলিত ধারণায় যা আসে তাকে আমরা সহজে ভুলতে পারি না। যে সূক্ষ শরীরে ১৭টি গুণ নিয়ে অবস্থা করছেন তার পুনরায় স্থুল দেহ ধারণ অন্যদিকে প্রকৃতিতে অর্থাৎ মাটিতে বীজ বপণ কারণে বীজের সেই সূক্ষ এবং সুপ্ত শক্তিই অঙ্কুরিত হয়ে বৃক্ষাদি শস্যাদি রূপ ফল আমাদের দেন। প্রত্যেক দেব-দেবীর বা সৃষ্টির এরূপ সূক্ষ দেহ আছে, সেই দেহের আহ্ববান করি ঘটে, পটে (ছবিতে), মূর্তিতে। শিবলিঙ্গও তদ্রুপ সৃষ্টির সূক্ষ দেহ।
শিব লিঙ্গ পূজার তাৎপর্য :
শিব পূজা দুই রকম ভাবেই হয়। মূর্তি এবং লিঙ্গ। পূবেই বলা হয়েছে লিঙ্গ শব্দে অনেকগুলো অর্থ আছে। লিঙ্গ শব্দের অর্থ চিহ্ন বা প্রতীক। সাকার রূপে এরূপ লিঙ্গ শরীর বা চিহ্ন আমরা সর্বত্রই ব্যবহার করি। একটি দেশের পরিচয় বহন করে একটি পতাকা। বিষ্ণুমন্ত্রের যারা অনুসারী তাদের পরিচয় তারা দেন দেহতে তিলক ফোঁটা অঙ্কিত করে। ঘটে আমরা দেবদেবীর পুত্তলী এঁকে দেবতার চিহ্ন বা প্রতীক বসাই। এরূপ দুটি প্রতীক বা লিঙ্গ বা চিহ্ন আমরা পূজায় ব্যবহার করি। একটি শিব লিঙ্গ আরেকটি নারায়ণ শিলা। শিব লিঙ্গের গঠন প্রণালী সহজ হওয়ায় মূর্তি তৈরি থেকে লিঙ্গপূজায় আমরা আগ্রহী বেশি। মাটি দিয়ে অতি সহজে অল্প সময়ে এ প্রতীক তৈরি করা যায় এবং পূজান্তে বিসর্জনও দেয়া যায়। কিন্তু প্রতীকটির নাম লিঙ্গ দেয়াতে আমাদের মধ্যে এ নিয়ে নীল সাহিত্য গড়ে উঠেছে যা সত্যিই দুঃখজনক। অথচ একই প্রতীক ব্যবহৃত হচ্ছে নারায়ণ পূজায়, তাকে নিয়ে এরূপ আচারণ আমরা করি না। বিশেষ করে শিব-এর সঙ্গে সৃষ্টির কার্যক্রম যুক্ত থাকাতে আমরা লিঙ্গ শব্দটিকে একেবারে পার্থিব কাজের সঙ্গে মিলিয়ে দিয়েছি। এ বিভ্রান্তি থেকে আমাদের মুক্ত হতে হবে এবং আমাদের শিবত্বে উন্নীত হতে হবে।
শিবের হাতে ত্রিশূল কেন?
বস্তত শিবের পরিচয় ত্রিশূলেই বিজ্ঞাপিত। ত্রিশূলের তাৎপর্য কি? শাস্ত্র বলে ত্রিশূল হলো কুঞ্চিকা বা চাবি। মানুষ সিন্দুকে ধনরতœ রেখে প্রয়োজনে চাবি দিয়ে তা উন্মুক্ত করে ধনরতœ বের করে। শিবের ঐশ্বর্য-ভা-ার তত্ত্বময়। সে তত্ত্বগুণময় ও গুণাতীত। ত্রিশূলের ৩টি ফলক-সত্ত্ব, রজ, তমোগুণের প্রতীক। কিন্তু ঐ তিনটি ফলক একটি মাত্র সোজা দ- দ্বারা গ্রথিত। সোজা দ-টিই গুণাতীত তত্ত্বের প্রকাশক। ৩টি ফলক সৃষ্টি, স্থিতি ও লয়ের প্রতীক এবং সত্ত্ব গুণময় ফলকে আছেন বিষ্ণু, রজগুণময় ফলকে আছেন ব্রহ্মা এবং তমোগুণময় ফলকে আছেন সংহার দেবতা রুদ্র। শিবের ত্রিশূল এই ত্রিশক্তির আধার স্বরুপ।
শিবের বাহণ বৃষভ বা ষাড় কেন?
স্বাভাবিক অবস্থায় বৃষ শান্ত, নিরীহ, অনুগত, লোকহিতকারী, কৃষি ও পরিবহণ কাজে গৃহস্থের নিত্য সহায়ক। ক্রুদ্ধঅবস্থায় বৃষভ দুর্ধর্ষ, ভীষণ সংহার মূর্তি, বীর্যবান। একারণেই বৃষভ হয়েছে শিবের বাহন। ‘বৃষভ’ শব্দটির অর্থ বলবান এবং শুক্রল। কৃষি, পরিবহণের কাজের দ্বারা যেমন সে গৃহস্তের উপকার করে তেমনি প্রজননের ক্ষেত্রেও তার প্রয়োজন। একটি বৃষ বহু গাভীর কামনা পূরণে সমর্থ। আশুতোষ শিব নিত্য বরদ, তিনি ভক্তগণের কামনা বা অভীষ্ট পূরণে সদা তৎপর। ভক্তের মঙ্গল বিধানে তিনি অভীষ্টবর্ষী। তাই ‘বৃষভ’ শিবের বাহন যুক্তিযুক্ত।