‘পদে’র মূল্য বোঝে না উন্নত বিশ্বের নেতারা
কাকন রেজা
বিশ্বের দেশে দেশে পদত্যাগের মহামারী দেখা দিয়েছে। এই ‘মারী’তে পদত্যাগ করেছেন সাইত্রিশ বছর ক্ষমতা আঁকড়ে থাকা জিম্বাবুয়ের প্রেসিডেন্ট রবার্ট মুগাবে। তার পতনে না-কী দেশটির জনগণ উল্লাসে মেতে উঠেছিল। পদত্যাগ করেছেন অস্ট্রেলিয়ার উপপ্রধানমন্ত্রী বার্নাবি জয়েস। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল যৌন কেলেংকারীর। একই অভিযোগে পদত্যাগ করেছেন সাহায্য সংস্থা ইউনিসেফে’র ডেপুটি ডিরেক্টর জাস্টিন ফরসিথ। রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্বের অভিযোগে পদত্যাগ করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই’র দ্বিতীয় শীর্ষ কর্মকর্তা এন্ড্রু ম্যাকক্যাব। এগুলো সবই সম্প্রতির উদাহরণ।
উন্নত দেশগুলোতে সম্ভবত পদত্যাগের ‘রোগ’টা বেশি, মহামারীর মতন। কিছু হলেই পদত্যাগ। এই কদিন আগে বৃটেনের এক মন্ত্রীর কায়কারবারে তো মাথা খারাপ অবস্থা। ‘হাউস অব লর্ডস’ তথা পার্লামেন্টের সভায় পৌছতে এক মিনিট দেরি হওয়ায় পদত্যাগ করে বসলেন লর্ড মাইকেল বেটস নামের সেই মন্ত্রী। তাও যে সে মন্ত্রী নয়, ‘আন্তর্জাতিক উন্নয়ন’ বিষয়ক মন্ত্রী।
বললেন, ‘আমি যথা সময়ে আমার জায়গায় উপস্থিত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে প্রশ্নের জবাব না দিয়ে অশোভন আচরণ করায় আন্তরিকভাবে ক্ষমা প্রার্থনা করছি। আমি সব সময়ই বিশ্বাস করেছি সরকারের পক্ষে আইনপ্রণেতাদের প্রশ্নের জবাব দিতে আমাদের উচিত সর্বোচ্চ মান নিশ্চিত করা। আমি আমার জায়গায় উপস্থিত থাকতে না পারায় খুবই লজ্জিত এবং এজন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমার পদত্যাগের আবেদন করছি।’ তার বক্তব্যের পর সভার অনেকেই ‘নো নো’ ধ্বনি দিয়েছিলেন, কিন্তু শোনেননি মাইকেল বেটস।
একে অসুখ ছাড়া কী বলবেন? মাত্র এক মিনিট, কত শত মিনিট দক্ষিণ এশিয়ার মানুষদের ‘মন্ত্রী’ দর্শনে ব্যয় করতে হয়। বছরে কত কর্মঘন্টার দাপ্তরিক অপচয় হয়, সংসদে কোরাম হয় না। তাও দক্ষিণ এশিয়ায় কেউ পদত্যাগ করেন না, আর মাত্র এক মিনিট! এসব পাগলামি ছাড়া আর কী। মূলত ‘সুখে থাকলে ভূতে কিলায়’ এই প্রবাদটি বোধহয় উন্নত বিশ্বের বেলায় সত্যি। একবার জাপানের প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠলো, দুম করে পদত্যাগ করে বসলেন। ‘পদ’ জিনিসটির মূল্যই এরা বোঝেন না, একটু কিছু হলেই ‘ত্যাগ’ করে বসেন। ‘পদে’রমর্যাদা বোঝেন মূলত উন্নয়নশীল দেশের নেতারা। রবার্ট মুগাম্বের কথা ধরুন, সাইত্রিশ বছর পদ আঁকড়ে রেখেছেন। সাইত্রিশ বছর ধরে জিম্বাবুয়ের উন্নয়নে কত ঝামেলা সয়েছেন। এমন ধারাবাহিকতার ছেদ ঘটিয়ে তাকে পদত্যাগ করতে হয়েছে।এ ‘ত্যাগ’ অত্যন্ত কষ্টের, যাতনার।
যারা এই পদত্যাগের পেছনে কাঠি করেছেন, তারা কী করে বুঝবেন ধারাবাহিকতার গুরুত্ব। ধারাবাহিকতা বোঝেন নাটক-সিনেমার পরিচালকেরা। এক শটে নায়িকার নীল শাড়ি, অন্য শটে লাল, এমন হলে সিকোয়েন্সের বেজে বারোটা। সুতরাং ধারাবাহিকতা বিষয়টি অত্যন্ত জরুরি।উন্নত বিশ্বের লোকজন বুঝতে চান না ধারাবাহিকতা না থাকলে সিনেমার মতন ‘উন্নয়ন’ বিষয়টিও ফ্লপ মারতে পারে।
বছর কয়েক আগে প্রশ্নপত্রে ভুল থাকায় দক্ষিণ কোরিয়ার শিক্ষামন্ত্রী পদত্যাগ করেছিলেন। বলেন তো কান্ড, মানুষ মাত্রেই ভুল হয়। ‘আই এ্যাম জিপিএ ফাইভ’রা বলেন ‘ম্যান ইজ মর্টাল’! কাজ করতে গেলে তো ভুল হবেই, আর এটা না বুঝেই পদত্যাগ করেছিলেন কোরিয়ার বেচারি শিক্ষামন্ত্রী।
হয়তো মনে মনে ভয় পেয়েছিলেন, ভেবে ছিলেন কর্ম সাধনের যোগ্যতা তার নেই, তাই মানে মানে কেটে পড়েছিলেন। কিন্তু এই দক্ষিণ এশিয়া অত ভীতু মানুষদের জন্ম দেয়নি, যে হুটহাট ‘পদত্যাগ করবে। এখানের‘মহাজন’রা ‘পদে’র মূল্য বোঝেন। সব ‘ত্যাগে’ই যে মোক্ষলাভ হয় না, এটা বোঝেন আরো ভালো ভাবে। আর সে কারণেই বীরভোগ্যা দক্ষিণ এশিয়ায় ‘পদত্যাগ’ ভীতু ও দুর্বলদের কর্ম। এমনতর কর্ম সর্বৈব পরিত্যাজ্য।
ফুটনোট : চাণক্য বলেছেন,‘অন্তঃসার শূন্যদের উপদেশ দিয়ে কিছু ফল হয় না, মলয়-পর্বতের সংসর্গে বাঁশ চন্দনে পরিণত হয় না।’
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট/সম্পাদনা : মোহাম্মদ আবদুল অদুদ