‘আসাম হতে যাচ্ছে ভারতের রাখাইন’
মাছুম বিল্লাহ : ভারতের আসাম হতে যাচ্ছে আরেকটি রাখাইন- এমনই আশঙ্কা করে আসামের সিনিয়র সাংবাদিক উৎপল বরদলৈ সাউথ এশিয়ান মনিটরে এক কলামে লিখেছেন, আসামের লাখ লাখ মানুষ যখন তারা নাগরিক না বিদেশি তা জানার জন্য উদ্বেগের সাথে অপেক্ষা করছে, তখন দেশটির সেনাপ্রধান এই বলে রাজনৈতিক গ্রেনেড নিক্ষেপ করেছেন যে বাংলাদেশ থেকে যাওয়া অভিবাসীরা আসলে চীনের সমর্থনে পাকিস্তানের পরিকল্পিত ছায়া যুদ্ধের অংশ। তার এই বিস্ফোরক মন্তব্যের মাত্র দু’দিন আগে গত মঙ্গলবার ভারতের সুপ্রিম কোর্ট ‘ন্যাশনাল রেজিস্টার অব সিটিজেন্স’ (এনআরসি)-এর চূড়ান্ত তালিকা ৩০ জুনের মধ্যে প্রকাশের নির্দেশ দেয়।
ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকা রেজিস্টার জেনারেল অ্যান্ড সেন্সাস কমিশনার অব ইন্ডিয়া ১ জানুয়ারি এনআরসির প্রথম খসড়া প্রকাশ করে।
ভারতের সুপ্রিম কোর্ট নিবন্ধন তালিকা প্রণয়নের নির্দেশ দিয়েছে, তারাই তা তদারকি করছে। আদালত বাংলাদেশ থেকে জনসাধারণের ঢলকে ‘জনসংখ্যা আগ্রাসন’ হিসেবে অভিহিত করেছে। এনআরসির প্রথম খসড়ায় আসামে ভারতের নাগরিক হিসেবে ১৯ মিলিয়ন লোককে তালিকাভুক্ত করে। তালিকার বাইরে থাকে ১৩.৯ মিলিয়ন। এদের বেশির ভাগই বাংলাভাষী মুসলিম অভিবাসী বা তাদের বংশধর।
এই প্রেক্ষাপটে লাখ লাখ মানুষ রাষ্ট্রহীন হয়ে ভারত থেকে বিতাড়িত হওয়ার শঙ্কায় রয়েছে। নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন ভারতের ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) সরকার ইতোমধ্যেই এ নিয়ে পার্লামেন্টে একটি আইন প্রণয়ন করেছে। বিজেপির লক্ষ্য হলো ভারতকে হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত করা। ভারতের জমিয়ত উলেমা-ই-হিন্দের সভাপতি সিনিয়র ভারতীয় মুসলিম নেতা মাওলানা আরশাদ মাদানি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছেন, আসাম হতে পারে ভারতের রাখাইন।
আসামের জনসংখ্যা সর্বশেষ আদমশুমারি অনুযায়ী ২০১১ সালে ছিল ৩১.২২ মিলিয়ন। এদের মধ্যে এক তৃতীয়াংশের বেশি তথা ১০.৭ মিলিয়ন বা ৩৪.৩ ভাগ ছিল মুসলিম।
ভারতীয় সেনাপ্রধান জেনারেল বিপিন রাওয়াতের বাংলাদেশ থেকে আসামে অবৈধ অভিবাসী যাওয়া এবং অঞ্চলটির পরিবর্তনশীল জনসংখ্যা নিয়ে মন্তব্য ভারতে রাজনৈতিক বিতর্কের সূচনা করেছে। তার ওই বক্তব্য নিশ্চিতভাবেই ভারত ও বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও চীনের মধ্যে কূটনৈতিক বিরোধের সৃষ্টি করবে। গত বুধবার সেনাপ্রধান বাংলাদেশ থেকে অব্যাহত জনসংখ্যার আগমনের ব্যাপারে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন এটি হলো চীনের সহায়তায় পাকিস্তানের ছায়াযুদ্ধ।
জেনারেল রাওয়াত নয়া দিল্লিতে ‘নর্থ ইস্ট রিজিয়ন অব ইন্ডিয়া- ব্রিজিং গ্যাপ অ্যান্ড সিকিউরিং বর্ডার্স’ শীর্ষক এক সেমিনারে বক্তৃতাকালে ওই মন্তব্য করেন। এতে নিরাপত্তা এস্টাবলিশমেন্টের সিনিয়র ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন।
আসামে মুসলিম জনসংখ্যার বৃদ্ধির কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমার মনে হয় না এখন ওই এলাকার জনসংখ্যার চিত্র বদলানো যাবে। সরকারে যারাই থেকে থাকুক না কেন, পাঁচ থেকে আট বা নয়টি জেলায় আগ্রাসন চালানো হয়েছে।
বাংলাদেশের সিলেটের কাছে অবস্থিত করিমগঞ্জ ও হেইলাকান্দি জেলা দুটি দক্ষিণ আসামের বরাক উপত্যকায়। অন্যান্য জেলা ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায়। ধুবরি, গোয়ালপাড়া ও বনগাইগাঁও হলো ময়মনসিংহ সীমান্তের কাছে। নগাঁও ও মরিগাঁও জেলা দুটি মধ্য আসামে। বরপেটা ও দারাঙ পশ্চিম-মধ্য আসামে।
আসামের ১২৬টি রাজ্য বিধান সভার আসনের মধ্যে মুসলিম ভোটারদের প্রভাবশালী অবস্থান রয়েছে ৪৯টিতে। ২০১৬ সালে অনুষ্ঠিত গত নির্বাচনে মুসলিমরা ২৯টিতে জয়ী হয়েছে। ১৯৫২ সাল থেকে মুসলিম ভোট একচ্ছত্রভাবে পেয়ে আসা কংগ্রেস পেয়েছে ১৫টি। ২০০৫ সালে মাওলানা বদরুদ্দিন আজমলের প্রতিষ্ঠিত অল ইন্ডিয়া ইউনাইটেড ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট (এইডইউএফ) ১৩টিতে, বিজেপি ১টিতে জয়ী হয়েছে। দলটি ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত ভারতের পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ লোকসভায় ১৪টি আসনের মধ্যে ৩টিতে জয়ী হয়েছে। তারা হলেন বদরুদ্দিন (ধুবরি) এবং তার ভাই সিরাজউদ্দিন (বরপেটা। তৃতীয় আসনটিতে জয়ী হয়েছেন রাধেশ্যাম বিশ্বাস। তিনি বরাক উপত্যকার করিমগঞ্জ আসন থেকে জয়ী হয়েছেন।
আসামের মুসলিম জনসংখ্যার অবস্থানের বিষয়টি সামরিক কৌশলের জন্য তাৎপর্যপূর্ণ বিষয়। ভারতীয় সেনাবাহিনী বেশ ভালোভাবেই জানে, করিমগঞ্জ ও হেইলাকান্দি ছাড়া বাকি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জেলাগুলো উত্তর পূর্ব ভারতের ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় দেশটির প্রধান লাইন অব কমিউনিকেশনে (এলওসি) অবস্থিত। ধুবরি, গোয়ালপাড়া ও বনগাঁও জেলা তিনটি মূল ভারত ও উত্তর পূর্ব ভারতের মধ্যে সংযোগকারী মাত্র ২৭ কিলোমিটার চওড়া শিলিগুড়ি তথা ‘চিকেন্স নেক’-এর কাছাকাছি অবস্থিত। চীন এর মাত্র ১৩০ কিলোমিটার উত্তরে ডোকালামে অবস্থান করছে। ২০১৭ সালের মধ্যভাগে ভুটান-চীন-ভারতের সন্ধিক্ষণে অবস্থিত স্থানটিতে দুই পরাশক্তি মুখোমুখি হয়েছিল। চীন পুরো এলাকায় উপরিভাগে অবস্থান করছে।
আসামের অভিবাসী মুসলিমদের নিয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনী অনেক দিন থেকেই দোলাচলে রয়েছে। ১৯৬২ সালে ভারতে চীনা হামলার পর থেকেই এমনটি হচ্ছে। ওই সময় বর্তমানে অরুনাচল প্রদেশ নামে পরিচিত তাওয়াং-কামেঙ-বমদিলা সেক্টরে ঢুকে পড়ে পিএলএ। চীন দাবি করে, স্থানটি দক্ষিণ চীনের অংশবিশেষ। চীন ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার একটি বড় অংশও দখল করে নিয়েছিল। তবে তারা পরে একতরফাভাবে প্রত্যাহার করে নেয়। ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের সময়ও তারা কাজটি আবার করে। ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলো এ তথ্য জানিয়েছে। সাউথ এশিয়ান মনিটর।