শ্রীদেবী, মাধ্যমের দেবী বন্দনা এবং ‘শ্রী’হীনের ‘দেবী’
কাকন রেজা
এক.
‘শ্রীদেবী’ এক সময়ে বলিউডের হিট নায়িকা। তার মৃত্যুতে সিনেমাপ্রেমিরা বিষাদিত হবেন এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমাদের দেশের গণমাধ্যমগুলোর আকুলতা-আহাজারী দেখে মনে হচ্ছে ‘থেমিস’ হচ্ছেন আইনের দেবী, ‘শ্রীদেবী’ হচ্ছেন কিছু মাধ্যমের সাম্প্রতিক ‘দেবী’। চারিদিকে রীতিমত হুতাশন রব। জানি, বিষয়টিকে পাঠক-দর্শক চাহিদা, সাথে অন্য নানা চাহিদা এবং সেলিব্রেটি বিষয়ক অন্যান্য ফর্মুলায় বোঝাতে চাইবেন অনেকে। আবার কেউ স্ট্রেইট বলে দিবেন, গাধা। সাংবাদিকতার কিছু না বোঝা অকাট মূর্খ। আলোচনার শুরুতেই স্বীকার করে নিই, কথা সত্য। আমি অকাট মূর্খ এবং গাধাই। বলা যায়, প্রয়াত কবি শামসুর রাহমানের ‘ঝাঁকের কই’।
যারা মাধ্যম চালান, হোক গণ, সামাজিক কিংবা বিনোদন, সব মাধ্যমেই ‘চাহিদা’র চাইতে অগ্রাধিকার প্রাপ্ত হলো ‘গুরুত্ব’। চাহিদা থাকলেই কী সব প্রকাশ-প্রচার সম্ভব, তাহলে তো বই মেলায় ‘রসময় গুপ্তে’র গর্বিত উপস্থিতি থাকতো। জানি এখানেও বিভাজন রয়েছে চাহিদা আর জনপ্রিয়তার মধ্যে। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে দেশ সবার উপরে। পঁচিশ ফেব্রুয়ারি শ্রীদেবী মারা গেছেন। পঁচিশ ফেব্রুয়ারির সেই মৃত্যুকে ছাপিয়ে ছিল ‘পিলখানা ট্র্যাজেডি’র দিন, সাতান্ন জন সেনা কর্মকর্তার শহিদ হবার দিন। কিন্তু মাধ্যমগুলো দিকে তাকান, বেশিরভাগেরই হা-হুতাশ শ্রীদেবীকে ঘিরে। বিদেশি সংবাদ মাধ্যম ‘বিবিসি’ বরং পিলখানা ট্র্যানজেডি বিষয়ে এগিয়ে ছিল। গুরুত্বের ‘গুরুত্ব’ বোঝারও মানসিক শক্তি ও মেধার সক্ষমতা লাগে।
তবে ‘শ্রীদেবী’ মরেও অনেককে বাঁচিয়ে দিয়ে গেছেন, অন্তত আমাদের দেশে। সে অর্থে তার নামকরণ স্বার্থক, অনেক ‘শ্রী’হীনের ‘দেবী’ হয়েই রইলেন তিনি।
দুই.
দক্ষিণ এশিয়ায় ‘দেবী’ বন্দনার বিষয়টি অনেকটাইসংস্কৃতি বাহিত। যদিও এই অঞ্চলের মুসলিমরা ধর্মীয় কারণে ‘বন্দনা’ সংস্কৃতিকে ত্যাগ করেছেন। তবুও অনেকেই এই ‘বন্দনা’কে ‘মন্দ না’ বলে আঁকড়ে রেখেছেন সযতনে। ‘দেবী’ বন্দনার আরেকটি পিঠ হচ্ছে ‘শক্তি’র অর্চনা। এমন ‘বন্দনা’ আর ‘অর্চনা’ আধ্যাত্মিক হলে সমস্যা ছিল না। কিন্তু সমকালীন সময়ে এই চর্চা আধ্যাত্মিকতা অতিক্রমন করে পৌঁচেছে মানুষে, ব্যক্তি কেন্দ্রিকতায়। সমস্যাটা এখানেই।
দক্ষিণ এশিয়ায় একজন রাজনৈতিক, ধর্মীয় বা সামাজিক ব্যক্তিত্বের প্রয়ানে যে রকম বিষাদের প্রকাশ ঘটে, তার অনেক বেশি আহাজারী প্রকট হয় কোন সেলিব্রেটির মৃত্যুতে। ‘অভিনেতা’ এখন ‘নেতা’কে হামেশাই ছাড়িয়ে যান। অভিনেতা বা সেলিব্রেটি প্রশ্নে আসি, দক্ষিণ ভারতীয় অভিনেতা কমল হাসান সাম্প্রতিক রাজনৈতিক দল গঠন করেছেন। সাড়াও মিলেছে। অমিভাভ, রজনীকান্ত এমন কী কলকাতার তাপস পাল সবাই জড়িয়ে গেছেন রাজনীতিতে। পাকিস্তানের আরেক সেলিব্রেটি ক্রিকেট তারকা ইমরান খানও দল গঠন করেছেন, স্বপ্ন দেখছেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার। দক্ষিণ এশিয়ার এমন ধারায় আমরাও কী খুব বেশি পিছিয়ে? হোক, সেলিব্রেটিরা রাজা-ধিরাজ হোক;কোনো আপত্তি নেই, তবে যোগ্যতায় হোক। যেমন হয়েছিলেন দক্ষিণ ভারতের জয়ললিতা। নায়িকা যিনি সাধারণ মানুষের ‘আম্মা’ উঠেছিলেন।
মূল কথায় ফিরি। ‘শ্রীদেবী’র মৃত্যু নিয়ে ভারতীয় গণমাধ্যমের আহাজারীর সাথে আমাদের দেশের সার্বিকতার পার্থক্য রয়েছে। ভারতের যাপিত জীবনে সিনেমার অবস্থানটি বিশেষ। ফলে মাধ্যমগুলোতে প্রদর্শিত হয় সেই বিশেষত্বেরই ‘মিরর ইফেক্ট’। বিশেষ করে টেলিভিশন এ ব্যাপারে এগিয়ে। নিউজ চ্যানেলগুলো অবশ্য অন্য বিষয়কেও গুরুত্ব অনুযায়ী সমুখে আনছে। তা সত্বেও ‘ডিউরেশনে’রহিসাবে এগিয়েসিনেমাই।সুতরাং ভারতে ‘শ্রীদেবী’র মৃত্যু একটা ‘ফ্যাক্টর’। কিন্তু আমাদের দেশে?
এমন প্রশ্নের উত্তর ¯্রফে‘না’। আমাদের পারিপার্শ্বিকতা ভিন্ন।এ ভূখন্ডের মানুষ মানসিকতায় বরাবরই রাজনীতি সচেতন। কখনো হয়তোসেই প্রকাশ রহিত থাকে চাপে কিংবা তাপে। তারপরও সব ছাপিয়ে তারা জানতে চায় চারিদিকে কী ঘটছে, বিশ্লেষন করতে চায় কেন ঘটছে।
এটাই এ দেশের সাধারণ মানুষের অগ্রসরমানতা। যারা আমজনতার এমন আকুলতাকে ‘দেবী’ বন্দনায় ‘উড়িয়ে-তাড়িয়ে’ দিতে চাচ্ছেন তাদের ভুলের পরিমান নির্ধারণ করবে সময়। ‘মহাকালে’র সেই হিসাবের মাশুল গুনতে হবে নিশ্চিত সবাইকেই।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট
সম্পাদনা : মোহাম্মদ আবদুল অদুদ