এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম
তারানা হালিম
বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণকে জাতিসংঘের ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতির সনদের অনুলিপি- মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা বিভাগ ডিএফপি (তথ্য মন্ত্রনালয়), ফিল্ম আর্কাইভ (তথ্য মন্ত্রনালয়), বাংলাদেশ বেতার (তথ্য মন্ত্রনালয়) এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগকে গতকাল মঙ্গলবার গণভবনে আনুষ্ঠানিকভাবে হস্তান্তর করেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী।
“৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণ রমনার রেসকোর্স ময়দান (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) রিলে করে শাহবাগ বেতার ভবনের মাধ্যমে সরাসরি সম্প্রচারের সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছিলেন বেতারকর্মীরা। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুরু হওয়ার সময় ছিল বেলা তিনটায়। দুপুর ১২টায় দ্বিতীয় অধিবেশনের শুরু বারবার প্রচার করা হচ্ছিল ভাষণের পূর্ব ঘোষণা। সেই সঙ্গে অসহযোগের স্লোগান ও দেশাত্মবোধক গান। বেলা ৩টা ২০ মিনিটে বঙ্গবন্ধুর গাড়ি সভাস্থলে পৌঁছায়। সঙ্গে সঙ্গে ১০ ১২ লক্ষাধিক কণ্ঠে ধ্বনিত হতে থাকে মহাসমুদ্রের গর্জন, ‘জয় বাংলা/ জয় বঙ্গবন্ধু’, ‘তোমার-আমার ঠিকানা/ পদ্মা, মেঘনা, যমুনা’। বঙ্গবন্ধু মঞ্চের ওপর দাঁড়িয়ে দুহাত তুলে সেই স্লোগানে সাড়া দিচ্ছিলেন। ঠিক সেই সময় শাহবাগ বেতার ভবনের ডিউটিরুমে টেলিফোনে সামরিক বাহিনীর গণমাধ্যম কর্মকর্তা মেজর সিদ্দিক সালিক বেতারে কর্তব্যরত অফিসারকে ইংরেজি ভাষায় সামরিক কর্তৃপক্ষের এক বার্তা পড়ে শোনায়, যার মর্মার্থ পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত শেখ মুজিবুর রহমানের কোনো ভাষণ বেতারে প্রচার করা যাবে না। সঙ্গে সঙ্গে কন্ট্রোলরুম হটলাইনে সভার মঞ্চে কর্তব্যরত বেতারের আঞ্চলিক পরিচালক আশরাফ-উজ-জামান খানকে বার্তাটি পড়ে শোনানো হলো। বঙ্গবন্ধু ইতিমধ্যে তাঁর ভাষণ শুরু করেছেন। আঞ্চলিক পরিচালক দ্রুত নেতার কাছে গিয়ে তাঁকে সামরিক কর্তৃপক্ষের নিষেধাজ্ঞার কথা জানালেন। এ কথা শুনে বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণের মধ্যেই নির্দেশ দিলেন, ‘মনে রাখবেন কর্মচারীরা, রেডিও যদি আমাদের কথা না শোনে, তাহলে কোনো বাঙালি রেডিও স্টেশনে যাবে না। যদি টেলিভিশন আমাদের নিউজ না দেয়, তাহলে টেলিভিশনে যাবেন না।’
এই নির্দেশ হটলাইনে শোনার পর বেতারকর্মীরা আঞ্চলিক পরিচালকের কথামতো কোনো ঘোষণা ছাড়াই তাৎক্ষণিকভাবে সম্প্রচার বন্ধ করে বেতার কেন্দ্র বের যান। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ বেতারে প্রচার করা সম্ভব না হলেও মঞ্চে কর্তব্যরত বেতারকর্মীরা ছোট মেশিনে সম্পূর্ণ ভাষণ রেকর্ড করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু ‘এবারের সংগ্রাম, আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’Ñএই ঐতিহাসিক ঘোষণা দিয়ে ভাষণ শেষ করার পর এলিফ্যান্ট রোডে এক সহকর্মীর বাসায় আঞ্চলিক পরিচালকের নেতৃত্বে কর্মীদের এক জরুরি সভায় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়, বঙ্গবন্ধুর ভাষণ প্রচার করা না হলে বেতারের সব অনুষ্ঠান প্রচার বন্ধ থাকবে এবং কোনো কর্মী বেতার কেন্দ্রে যাবেন না। এ সময় ছোট সমস্যা দেখা দেয়। পূর্ব রেডিও পাকিস্তান ঢাকার স্টুডিও অনুষ্ঠান না পেলে ট্রান্সমিটার বা প্রেরণ কেন্দ্র বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে রেকর্ড বাজানোর নির্দেশ ছিল। সেটি বন্ধ করতে হবে। তখন বিকেল ৪টা ৩০ মিনিটে তৃতীয় অধিবেশন শুরু হতো। সে মুহূর্তে সময় ছিল মাত্র ১৫ মিনিট। তখন সাভার প্রেরণ কেন্দ্রের সঙ্গে সরাসরি টেলিফোন যোগাযোগব্যবস্থাও ছিল না। অবশেষে তৃতীয় অধিবেশন শুরু হওয়ার মাত্র পাঁচ মিনিট আগে ট্রাংককলে আঞ্চলিক পরিচালক সাভারের বেতারকর্মীদের অধিবেশন চালু না করে প্রেরণ কেন্দ্র ও আবাসিক কোয়ার্টার ত্যাগ করে দূরে চলে যেতে বলেন। তাঁরাও সেই নির্দেশ পালন করেছিলেন। এই সিদ্ধান্ত কার্যকর করার ফলে সেদিন ঢাকা বেতার কেন্দ্রের তৃতীয় অধিবেশন, অর্থাৎ বিকেল, সন্ধ্যা ও রাতের অনুষ্ঠান প্রচার সম্পূর্ণ বন্ধ যায়। ফলে তৎকালীন দেশের উভয় অংশ এবং বহির্বিশ্ব ঢাকার পরিস্থিতি সম্পর্কে থাকে সম্পূর্ণ অন্ধকারে। খুবই উদ্বিগ্ন পড়ে পিন্ডির প্রভুরা। তারা পূর্বাঞ্চলের সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীকে অবিলম্বে ঢাকা বেতার কেন্দ্র চালু করার জন্য নির্দেশ দেয়। এ সময় কৌশলগত কারণে আঞ্চলিক পরিচালক তাঁর বাসা ছেড়ে অন্যত্র অবস্থান করছিলেন। রাও ফরমান আলী অনেক খোঁজাখুঁজির পর রাত ১০টার দিকে টেলিফোনে তাঁকে বেতার কেন্দ্র চালু করতে বলেন। আঞ্চলিক পরিচালক তাঁকে জানান, বঙ্গবন্ধুর ভাষণ প্রচার করতে না দিলে কর্মীরা বেতার কেন্দ্রে যাবেন না। জেনারেল রাও তখন ভাষণ প্রচারের সম্মতি জানিয়ে অবিলম্বে অনুষ্ঠান প্রচার করতে বলেন। আঞ্চলিক পরিচালক তাঁকে বলেন, প্রকৌশল ও অনুষ্ঠান শাখার কর্মীদের খবর দিয়ে এনে স্টুডিও ও ট্রান্সমিটারের যন্ত্রপাতি চালু করে অনুষ্ঠান প্রচার রাতের অধিবেশনের সময়সীমার মধ্যে সম্ভব নয়। তার চেয়ে পরদিন ভোর পূর্ব ঘোষণা দিয়ে সকালে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ প্রচার করলে ভালো হবে। অগত্যা জেনারেল রাও ফরমান আলী আঞ্চলিক পরিচালকের কথা মেনে নিলেন। পরদিন, অর্থাৎ ৮ মার্চ সকাল ৮টা ৩০ মিনিটে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, রংপুর, সিলেট ও খুলনা বেতার কেন্দ্র একযোগে প্রচারিত হলো। বঙ্গবন্ধু তাঁর ৩২ নম্বর রোডের বাসভবনে ঢাকা কেন্দ্রের আঞ্চলিক পরিচালককে সঙ্গে নিয়ে তাঁর ভাষণ শুনছিলেন।
এরপর ২৫ মার্চ পর্যন্ত অসহযোগ আন্দোলনের প্রতিদিন ছয়টি বেতার কেন্দ্র এবং মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের প্রতিটি অধিবেশনে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ সম্পূর্ণ অথবা নির্বাচিত অংশ প্রচার করা হয়।
পাকিস্তান সরকারের অধীনে একান্ত আজ্ঞাবহ প্রতিষ্ঠান ছিল রেডিও পাকিস্তান। তারই অধীন বাঙালি বেতারকর্মীরা বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ বেতারে প্রচারের দাবিতে যে বলিষ্ঠ সিদ্ধান্ত ও সাহসী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন, তার কাছে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা প্রথমবারের মতো নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয় (বাংলাদেশ বেতারের সাবেক উপমহাপরিচালক, অনুষ্ঠান; আশফাকুর রহমান খান এর স্মৃতিচারণা)।
পরিচিতি : তথ্য প্রতিমন্ত্রী/ ফেসবুক থেকে