তথ্য প্রযুক্তির ফ্রাঙ্কেস্টাইন এবং কেনিয়ার রাজনৈতিক বিপর্যয়
কেনিয়ার সর্বশেষ নির্বাচন বৈশ্বিক রাজনীতিতে কিছু নীরব সতর্কবার্তা রেখে গিয়েছে। পূর্ব আফ্রিকার এই দেশটি প্রায় চল্লিশটি পৃথক আদিবাসী গোষ্ঠীর বসবাস। বৈশ্বিক মানব উন্নয়ন সূচকে দেশটির অবস্থান ১৪৮ তম, দেশটির মাত্র ২০% জনগোষ্ঠী বিদ্যুৎ সুবিধা পেয়ে থাকে, স্যানিটেশন সুবিধা রয়েছে মাত্র ৩০ ভাগ মানুষের জন্য। ভঙ্গুর অর্থনীতি ও অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশের এই দেশটির রয়েছে ১.৬ মিলিয়ন এইডস আক্রান্ত রোগীর বোঝা। সার্বিকভাবে বিভিন্ন সূচকে পিছিয়ে থাকা এই দেশটিতে ২০১৭ সালের নির্বাচনী প্রচারণার শুরু থেকেই তথ্য প্রযুক্তির অপব্যাবহার পরিলক্ষিত হয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও অন্যান্য গণমাধ্যমে ছিল ‘ফেকনিউজের’ আধিপত্য। গণমাধ্যমে বিভিন্ন বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রচার করে ভোটারদের মন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা এই নির্বাচনের সব থেকে উল্লেখযোগ্য দিক। আগস্টে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের ফলাফলে দেখা সর্বশেষ প্রেসিডেন্ট উহুরু কেনিয়াত্তা ৫৪ শতাংশ ভোটে বিজয়ী হয়। ফলাফল ঘোষণার পরেই পরাজিত প্রার্থীরা ইলা ওডিঙ্গা তার পরাজয়ের কারণ হিসাবে হ্যাকিংকে দায়ি করছে। নির্বাচনে ভোটার সনাক্তকরণে বায়োমেট্রিক পদ্ধতি ব্যবহার করা হলে ও বেশীর ভাগ ভোট কেন্দ্রে বৈদ্যুতিক সুবিধা না থাকায় তা সঠিক ভাবে কার্যকর হয়নি। অপরদিকে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবার আগে ভোটিং সিস্টেমের প্রশাসক ক্রিস মাসান্ডো হত্যাকা-ের শিকার হয়। বিরোধী শিবিরের দাবি কেন্দ্রীয় ‘ভোটিং ডাটাবেসে’ প্রবেশ ও হ্যাকিং এরজন্য ক্রিস মাসান্ডোকে হত্যা করা হয়। যদিও বিজয়ী প্রেসিডেন্ট উহুরু কেনিয়াত্তা হ্যাকিংয়ের অভিযোগ নাকজ করে দিয়েছেন। সর্বশেষ মার্কিন নির্বাচনে ওরাশিয়ান হ্যাকারদের সহযোগিতায় নির্বাচন জয়ের বিষয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বিরুদ্ধে অনেকে একই ধরনের অভিযোগ তোলেন। পরবর্তীতে কেনিয়ার সুপ্রিমকোর্ট এই নির্বাচনকে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে বাতিল ঘোষণা করে এবং ৬০ দিনের ভেতর নতুন নির্বাচন আয়োজনের নির্দেশ দেয়, যদিও পরবর্তী নির্বাচনে অংশগ্রহণ বিরত থাকে এবং কেনিয়াত্তা সরকার গঠন করে। কেনিয়ার সর্বশেষ নির্বাচন বিশ্লেষণে দুটি স্পষ্ট হয়। প্রথমত তুলনামূলক অস্থিতিশীল ও অনুন্নত রাষ্ট্রের জন্য ইলেকট্রনিক্স ভোটিং একটি অকার্যকর ব্যবস্থা। ই-ভোটিং পদ্ধতিতে নানা বিধ ঝুকি থেকে যায় এবং অনুন্নত রাষ্ট্রের দুর্বল অবকাঠামো ও আইনের সুশাসনের অভাব ই-ভোটিংকে অকার্যকর করে দিতে পারে। দ্বিতীয়ত, নির্বাচনী প্রচারনায় পাবলিক সেন্টিমেন্ট এনালাইসিস পদ্ধতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মত উন্নত রাষ্ট্রে বেশ পুরাতন হলে ও প্রযুক্তি অপব্যাবহারের অপ্রতিরোধ্য যাত্রা ‘ফেকনিউজ’ প্রচারের মাধ্যমে মানুষের মনের উপর প্রভাব বিস্তার করার বিষয়টি বর্তমানে কেনিয়ার মত অপেক্ষাকৃত অনুন্নত রাষ্ট্রে ও পৌঁছে গেছে। প্রযুক্তি অপব্যবহারের মাধ্যমে জনগণকে বিভ্রান্ত করা, প্রপাগন্ডা প্রচারের মাধ্যমে জনগণকে ভুল পথে ধাবিত করার কৌশল বিশ্বব্যাপী দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। প্রযুক্তির এই ফ্রাঙ্কেস্টাইন শাসক গোষ্ঠীকে শক্তিশালী করলে ও জনগণকে ক্রমশ দুর্বল ও রুদ্ধ করে ফেলছে। কেনিয়ার নির্বাচন প্রযুক্তির এই দান ফ্রাঙ্কেস্টাইনের বিষয়ে বিশ্ববাসীর জন্য একটি সতর্কবার্তা মাত্র। প্রযুক্তির সুফল বিশ্বব্যাপী না ছড়ালে ও, প্রযুক্তির ফ্রাঙ্কেস্টাইনে উন্নত-অনুন্নত সকল রাষ্ট্রেই সমান ভাবে অগ্রাসন করছে।
পরিচিতি : প্রকৌশলী/সম্পাদনা : মোহাম্মদ আবদুল অদুদ