অতিক্রান্ত জন্মদিন : সুসংবাদ ও দুর্ভাবনা
অজয় দাশগুপ্ত, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া থেকে
বাংলাদেশের জনক বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন পালিত হয়েছে মহা উৎসাহ আর উদ্দীপনায়। দেশে এর কতটা জৌলুস কতটা ব্যপ্তি, কতটা আন্তরিক আর কতটা কষ্টকল্পিত সেটা আমরা সবাই জানি। আমরা যারা জীবনের প্রায় শেষ দিকে বৃদ্ধ হওয়ার আগের স্তরে পৌঁছে গেছি আমরা এ দেশের ইতিহাসের অনেক কিছু নিজের চোখে দেখেছি। খুব বেশি দিনের কথা না। তার নামও নিতে দেওয়া হয়নি। একবার তার মর্মান্তিক বিদায়ের দিনে আয়োজিত নাগরিক শোকসভায় আমাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল মূলপ্রবন্ধ পাঠ করার। সেই নিবন্ধটি তখনকার আজকের কাগজ ছাপিয়েছিল। কিন্তু মনে আছে কত সুধী এখনকার আওয়ামীবান্ধব সেদিন সেই অনুষ্ঠানে আসেননি। তারা মনে করতেন, পরিবেশ নাজুক। তারা এলে তাদের ব্যবসা কাজ বা ক্যারিয়ারের ওপর বিরূপ প্রভাব পতে পারে। অনুমান মিথ্যা ছিল না। পড়তে পারত, পড়েছিলও। তাই বলেকি মানুষ পিছিয়ে থাকবে? সাধারণ মানুষ কখনোই স্বার্থ বা ধান্দার দিকটা ভাবে না। যে কারণে তখনকার মাঠের আওয়ামী লীগ আজকের সরকারি দলের চাইতে অনেক বেশি শক্তিশালী ছিল। আজ সুসময়ে সবাই আওয়ামী লীগ। সবার মুখে মুখে বঙ্গবন্ধু আর তার জয়গান। এটা যে কতটা সত্য সে আমরা সবাই বুঝি। মন খারাপ হয় যেসব নাগরিক সুশীলেরা আজ ভাবছেন আর কাজকর্মের কি দরকার, তিনি তো তার জায়গা নিয়ে নিয়েছেন তাদের আচরণে বিস্মিত হই। এরা খুব ভালো জানেন নোংরা রাজনীতি কতটা মারাত্মক। আর তারা গদীতে এলে কিভাবে প্রতিশোধ নিতে পারে। সংস্কৃতি ও সুধীজনদের এই নীরবতা কিংবা আপোস কিংবা স্তাবকতা কখন যে বুমেরাং হয়ে ফিরে আসে সেটাই ভয়ের।
তার জন্মদিনের একটা ঔজ্জ্বল্য আছে। সেটা ইতিহাসেই লেখা। তিনি এ দেশের মানুষের জন্য বারবার জেলে গিয়েছেন, জীবন দিয়েছেন। সময় কি তাকে উজ্জ্বল করবে না? সে কারণে তার এই জন্মদিনে আমরা দু’দুটো ভালো খবর পেয়েছি। তার জীবদ্দশায় কিসিঞ্জার আর নিক্সনের মতো ধুরন্ধর নেতারা চীন-পাকিস্তান মধ্যপ্রাচ্যকে সাধে নিবে আমাদের অকেজো রাষ্ট্রে পরিণত করার জন্য তলাবিহীন ঝুঁড়ি নাম দিয়েছিল। সেই ঝুঁড়ি আজ অনেকটাই কানায় কানায় পূর্ণ। পূর্ণ বলেই জাতিসংঘ বলছে, বাংলাদেশ আর কোনো অনুন্নত দেশ না তার নাম এখন উন্নয়নশীল দেশ। এই প্রাপ্তি তারুণ্য বুঝবে না। আমাদের কৈশোর যৌবন এমনকি মাঝবয়সেও আমরা দেখেছি কষ্ট কাকে বলে। যেকোনো সেক্টরে আমরা ছিলাম পশ্চাৎপদ। আমরা যে বেঁচে আছি সেটাই তো অনেক। গরিব দেশ বলে আমাদের পারমানবিক বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত গুঁড়োদুধ খাওয়াতেও পিছপা ছিল না পশ্চিমা দেশগুলো। অন্যের কাপড় ফেলে দেওয়া পোশাক ত্যাজ্য খাবার এইসব ছিল আমাদের জন্য বিলাস। সেই বাংলাদেশ আজ প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যার নেতৃত্বে এমন এক জায়গায় যেখানে তাকে সমীহ করছে বিশ্ব।
আর একটি ভালো খবর ছিল ক্রিকেটে শ্রীলঙ্কা বধ। নাটকীয় জয়ে খেলোয়াড়েরা বুঝিয়ে দিয়েছে স্বাধীন দেশে জন্মগ্রহণের শক্তি কি। এই জয়ের সাথে যে দুর্ভাবনা সেটা এখন ভেবে দেখতে হবে আমাদের। যেকোনো পরিবেশে আচরণ যেন এমন না হয় যাতে বিশ্বসভায় আমাদের মাথা হেঁট হয়ে আসে। বিপদে দুর্যোগে এমনকি পরাজয়েও মাথা ঠান্ডা আর নিজেদের সংহত রাখার যে পাঠ বঙ্গবন্ধু দিয়ে গেছেন তা কোথাও নেই। রাজনীতি দুর্নীতিগ্রস্ত। সমাজ কলুষিত। মানুষ মনে এক চিন্তায় আরেক। এই জাতি বঙ্গবন্ধুর মতো নেতাকে কিভাবে আরও মহান করবে তাহলে। তাই চলে যাওয়া জন্মদিনটি উৎসবের পাশাপাশি ভাবনার খোরাক রেখে গেছে অনেক। আমরা কি সেগুলো ভেবে দেখে সামনে এগোব?
লেখক: কলামিস্ট ও বিশ্ববিদ্যালয় পরীক্ষক