গণহত্যার ভিডিও এবং একজন নূরুল উলা
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতে বর্বর পাকিস্তানি সেনাদের অন্যতম লক্ষ্যবস্তু ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ওই রাতে পাক সেনারা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন এলাকা বিশেষ করে ইকবাল হল(বর্তমানে জহুরুল হক হল) ও জগন্নাথ হলে প্রচ- আক্রমণ পরিচালনা করে। উন্মত্ত উর্দিধারীরা জগন্নাথ হলে চালায় ভয়ঙ্কর গণহত্যা যা বিশ্ববাসী জানতে পারে ওই হত্যাকা-ের ১০ মাস পর এক ভিডিও চিত্রের মাধ্যমে। ওই ভিডিও চিত্র সংবাদ আকারে বিশ্বব্যাপি সম্প্রচার করে মার্কিন টেলিভিশন চ্যানেল এনবিসি (ন্যাশনাল ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশন)। সংবাদটি সম্প্রচার হয় ১৯৭২ সালের ৭ জানুয়ারি। নূরুল উলা’র ভিডিও’র উপর ভিত্তি করে এনবিসি’র জন্য প্রতিবেদনটি তৈরি করেছিলেন মার্কিন সাংবাদিক রন নেসেন। গণহত্যার অমূল্য সেই ভিডিও চিত্র ধারণ করেছিলেন বুয়েটের প্রভাষক নূরুল উলা। নূরুল উলা’র ওই অ্যামেচার ভিডিও বাংলাদেশের মাটিতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বর্বরতার প্রামাণ্য এক দলিল।
নূরুল উলা সে সময় জগন্নাথ হলের দক্ষিণে প্রাদেশিক পরিষদ ভবনের বিপরীতে বুয়েটের অধ্যাপকদের জন্য নির্মিত একটি চার তলা ভবনে থাকতেন। যেখান থেকে জগন্নাথ হলের পুরো মাঠ দেখা যেত। ২৫ মার্চ মধ্যরাতে (২৬ মার্চের প্রথম ভাগ) ঘন অন্ধকারের মধ্যে তিনি জগন্নাথ হলে মিলিটারির অস্তিত্ব টের পান। শুনতে পান গুলির প্রচ- শব্দ। পরদিন সকালে তিনি স্বচক্ষে দেখলেন পাক বর্বরতা। প্রথমে দুজন ছাত্রকে জগন্নাথ হলের মাঠে খুব কাছ থেকে গুলি করে হত্যা করে পাক সেনারা। এরপর অস্ত্রের মুখে দলে দলে মানুষকে নিয়ে এসে খুব কাছ থেকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এসব দেখতে দেখতে হঠাৎ করে নিজের অজান্তেই নূরুল উলা বলে উঠেন ‘ইস হাতে যদি একটা অস্ত্র থাকত’। এমন সময় তার পাশে থাকা চাচাত ভাই নসীম বলেন, ‘ভাইজান ছবি তোলেন।’ ছবি তোলার অস্ত্র নূরুল উলা’র ঘরেই ছিল। একটি ভিসিআর সেট!
ওই সময় নূরুল উলা’র ঘরে জাপানি কোম্পানির একটি ভিসিআর ছিল। এই ভিসিআর’টি ছিল ক্যামেরাসহ। এটা দিতে চলন্ত ছবি রেকর্ড করা যেত। এটা ছিল বেশ বড় আর ভারী। খুব দ্রুত ওই ক্যামেরাটি সেট করে একটি কালো কাগজের মধ্যে দিয়ে লেন্সটি ফুটো করে বের করে দিয়ে পাক সেনাদের গণহত্যার ছবি ভিডিও করতে শুরু করেন তিনি। রেকর্ড করেন বিশ্বের ইতিহাসের অন্যতম সেরা গণহত্যার লাইভ ফুটেজ। ওই দিন ভিডিও করার পাশাপাশি নূরুল উলা প্রত্যক্ষ করেন বর্বর গণহত্যা। স্মৃতিকথায় নূরুল উলা লিখেছেন, ‘গুলি যখন থামলো দেখলাম লোকটা তখনও বেঁচে আছে। মনে হল ওর দিকে সরাসরি কেউ গুলি চালায়নি। লোকটা আবার হাত জোড় করে প্রাণ ভিক্ষা চাইতে শুরু করল। একজন সৈন্য তাকে বুকে লথি মেরে মাটিতে শুইয়ে দিতে চেষ্টা করল, তার উপর গুলি চালালো। তার মৃতদেহ সবার সাথে একাকার হয়ে গেল।’ (১৯৭১:ভয়াবহ অভিজ্ঞতা, পৃষ্ঠা: ১৫ )
হত্যাকা- শেষে পাক সেনারা জগন্নাথ হলের মাঠ থেকে চলে যায়। এদিকে জগন্নাথ হলের পাশ দিয়ে এন্টেনা লাগানো একটা গাড়ি চলে যায়। নূরুল উলা’র ধারনা ওই এন্টেনার মাধ্যমে কোনো কিছু (বেতার তরঙ্গ বা টেলিভিশন) সম্প্রচার হচ্ছে কি না? তা পরীক্ষা করা হয়েছিল। এরপর তিনি দ্রুত ওই ভিসিআর যন্ত্রটি নষ্ট করে কারফিউর মধ্যেই বাড়ি থেকে বের হয়ে পড়েন। দীর্ঘ দিন যত্ম করে আগলে রাখেন ওই ক্যাসেট। তারপর নানা কঠ-খড় পুড়িয়ে তা সযত্মে পৌছে দেন বিদেশি গণমাধ্যম কর্মীদের কাছে। বিশ্ববাসী প্রত্যক্ষ করে পাক বর্বরতা।
লেখক : প্রভাষক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়