আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবসের স্বীকৃতির দাবি
১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ৩১৩টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসন পেয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলেও প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া এবং জুলফিকার আলী ভুট্টো আওয়ামি লীগকে সরকার গঠন করতে দেয়নি এবং মার্চের প্রথমে নির্ধারিত সংসদীয় সভা বাতিল করে। এরই প্রেক্ষিতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৭ মার্চ একাত্তর, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলনের ঘোষণা করেন তার ঐতিহাসিক ভাষণের মাধ্যমে। পাকিস্তানের ধারণা ছিল বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দিতে পারেন, এজন্য ওই দিন পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনী প্রস্তুত রেখেছিল ঢাকা আক্রমণের জন্য। পাকিস্তান সেনাবাহিনী, ‘অপারেশন সার্চলাইট’ এর গোপন পরিকল্পনা তৈরি করে এবং বাঙালি সেনা কর্মকর্তাদের কাছে খুব সতর্কতার সঙ্গে এই অপারেশনের পরিকল্পনার বিষয় গোপন রাখা হয়।
‘অপারেশন সার্চলাইট-এর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল বাঙালি সামরিক ও বেসামরিক বাহিনীর সদস্যদের নিরস্ত্রীকরণ ও বাঙালি জাতি ধ্বংস করা যা ছিল পরিকল্পিত এবং উদ্দেশ্য প্রণোদিত। ২৫ মার্চ রাতে ২২ বেলুচ রেজিমেন্ট পিলখানায় পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলসকে ঘুমন্ত অবস্থায় আক্রমণ করে এবং অগণিত বাঙালি সেনাকে হত্যা করে। ৩২ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট রাজারবাগ পুলিশ লাইনে আক্রমণ করে অধিকাংশ বাঙালি পুলিশকে হত্যা করে ওই রাতেই। পাকিস্তান সেনাবাহিনী ইস্ট-বেঙ্গল রেজিমেণ্টাল সেন্টারে আক্রমণ করে এবং হাজার হাজার নিয়োগপ্রাপ্ত বাঙালি সৈন্যদের হত্যা করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আক্রমণ করে ১২ জন শিক্ষকসহ অগণিত শিক্ষার্থীকে হত্যা করে। মিডিয়া হাউসগুলো জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। পাকিস্তান ভেবেছিল এই আকস্মিক আক্রমণ ও হত্যা বাঙালিদের চিরতরে নিস্তব্দ করে দিবে কিন্তু ঠিক এর উল্টোটাই ঘটেছিল। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাহসী ও দূরদর্শী নেতৃত্বে ২৫ মার্চের নির্মমতাকে পুঁজি করে আমরা দীর্ঘ ৯ মাস সংগ্রামের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা পেয়েছি ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ এ।
স্বাধীনতার ৪৬ বছর পরে হলেও বিগত ১১ মার্চ জাতীয় সংসদে ২৫ মার্চকে জাতীয় গণহত্যা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয় এবং আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবসের স্বীকৃতির ব্যাপারেও আলোচনা হয়, যদিও জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের, ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৫ রেজুলেশন নং- ৬৯/৩২৩ অনুসারে ‘৯ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস’ হিসেবে পালিত হচ্ছে।
আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেতে কিছুটা সময় লাগতে পারে। ‘রুয়ান্ডা গণহত্যা’ জাতিসংঘে স্বীকৃতি পেয়েছে। কারণ এর প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন আমেরিকার অ্যাম্বাসেডর অ্যাট লার্জ স্টিফেন রালফ। আর্মেনিয়ান গণহত্যা ( ১৯১৫-১৯১৭) দীর্ঘ ৬৮ বছর পরে আমেরিকার সিনেটে স্বীকৃতি পেয়েছিল ১৯৮৫ সালে, জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের স্বীকৃতিও পায় ১৯৮৫ সালেই এবং ১৯৮৭ সালে ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টে। বাংলাদেশ সরকার ২৫ মার্চকে আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস হিসেবে স্বীকৃতির জন্য জাতিসংঘে প্রস্তাবনা রাখার পাশাপাশি এই দাবিকে সফল করতে প্রয়াজনীয় কূটনৈতিক পদক্ষেপ গ্রহণ করবে বলে বাংলাদেশ হেরিটেজ ফাউন্ডেশন আশা করে। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের বন্ধুরাষ্ট্র এবং বর্তমান বন্ধুরাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে ২৫ মার্চ গণহত্যার ভয়াবহতার তথ্য প্রকাশ এবং আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় কূটনৈতিক আলোচনা গুরুত্বের সঙ্গে করবে করছি।
লেখক : সাবেক রাষ্ট্রদূত