জাতির জনকের স্বাধীনতার ঘোষণার বার্তা বুক পকেটে রাখেন মানিক চৌধুরী
উম্মুল ওয়ারা সুইটি : ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে বিজয়ী এমএনএ, ১৯৭৩ সালের আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য এবং বঙ্গবন্ধুর বিশ্বস্ত সহচর কমান্ড্যান্ট মানিক চৌধুরী। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণের পরই এলাকায় গিয়ে যুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু করেন। আর ২৫ মার্চের কালো রাতে বঙ্গবন্ধুর পাঠানো স্বাধীনতার ঘোষণা বার্তাটি হাতে পাওয়ার পর ২৬ মার্চ থেকে শুরু করেন যুদ্ধের চূড়ান্ত প্রস্তুতি।
দীর্ঘ ৯ মাস মানিক চৌধুরী এই ঘোষণাপত্র তার বুক পকেটেই রাখেন। মাঝে মাঝে বুক পকেট থেকে এই বার্তা খুলে পড়তেন এবং মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রেরণা দেওয়ার জন্য অন্যদের পড়ে শোনাতেন।
যুগভেরী পত্রিকায় ‘মুক্তিযুদ্ধে সিলেটের অবদান’ শিরোনামে কমান্ড্যান্ট মানিক চৌধুরী এমসিএ লিখেছেন ‘২৫ মার্চ রাত্রিতে বর্বর ইয়াহিয়া বাহিনী ঢাকার বুকে নিষ্ঠুরভাবে বাংলার নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা করতে লাগল। বাংলার নয়নমণি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ধরে নিয়ে গেল এবং এই পরিপ্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধু বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের পক্ষে স্বাধীনতা ঘোষণা করে দিকে দিকে যে বার্তা প্রেরণ করেছিলেন সেই বার্তার একটি কপি আমিও পেয়েছিলাম। রাত প্রায় সাড়ে ৪টার সময় আমার ঘরে শব্দ হল, পিয়ন এসে আমাকে একটা টেলিগ্রাম দিয়ে গেল। সে টেলিগ্রামটি বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে এসেছে বার্তা নিয়ে বাংলার স্বাধীনতার। তিনি ঘোষণা করেছেন বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রাম আরম্ভ হয়ে গেছে। বাংলাদেশ এখন স্বাধীন এবং শত্রু সৈন্যকে সর্বশক্তি দিয়ে প্রতিরোধ করতে হবে। এটাই আমাদের প্রথম সংবাদ। এই সংবাদ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্যাকুল হয়ে বেরিয়ে গেলাম গাড়ি নিয়ে। আমি তখন হবিগঞ্জে ছিলাম। হবিগঞ্জে আমার সহকর্মীরাও ছিলেনÑ কর্নেল রব, মোস্তাফা আলী, মোস্তফা শহীদ ছিলেনÑ আরো যারা ছিলেন সকলের কাছে এই বার্তা পৌঁছিয়ে দিলাম। যতটুকু খবর পেলাম, চারদিকে স্বাধীনতা সংগ্রাম আরম্ভ হয়ে গেছে।’
মানিক চৌধুরীর মেয়ে সংসদ সদস্য কেয়া চৌধুরীর একান্ত সাক্ষাৎকারে এই বার্তার কপিটি দেখিয়ে বলেন, মূলত বুক পকেটে থাকার কারণে এই পত্রটির কিছু কিছু জায়গা ছিঁড়ে গেছে। দেশ স্বাধীনের পর আমার বাবা আমার আম্মার কাছে এই বার্তাটি দিলেন এবং এটিকে যতœ করে রাখতে বললেন। আমার বাবা তখন আমার মাকে বলেছিলেন, আমি নয় মাস এই পত্রটি আমার পকেটে রেখেছি। কারণ আমি চেয়েছি আমি যদি শহীদও হয়ে যাই যেন বঙ্গবন্ধুর আদেশ নিয়ে শহীদ হতে পারি।
কেয়ার চৌধুরী বলেন, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের পর গণপরিষদের সদস্য ও আ.লীগের নেতাদের যার যার এলাকায় চলে যেতে বলা হয়। আমার বাবা তখন গণপরিষদের সদস্য ছিলেন। তার আসনটি ছিলো সেটি হলো বাহুবল, শ্রীমঙ্গল, চুনারুঘাট। এই তিনটি এলাকাই চা বাগান অধ্যুষিত। আমার আব্বা বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ শোনার পরপরই তার নির্বাচনি এলাকায় চলে আসলেন। এসে তিনি যুদ্ধ করার জন্য অস্ত্র খোঁজা শুরু করলেন। চা শ্রমিকদের নিয়ে চুনারুঘাটের চাঁনপুর চা বাগানে একটি তিরন্দাজ বাহিনী গঠন করলেন। ঐ তিরন্দাজ বাহিনী মূলত ২৫ মার্চের আগে ঢাকা-সিলেট রোর্ডে তাদের তীর ধনুক দিয়ে প্রথম প্রতিরোধ যুদ্ধ সংঘটিত করেছিলো।
মানিক চৌধুরীর কন্যা বলেন, ২৫ মার্চ রাত সাড়ে তিনটা বা চারটার দিকে কেউ একজন দরজা নক করে। একচেঞ্জ অফিস থেকে আমার বাবাকে এই কপিটা (স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রটি) দেওয়া হয়। বাবাকে বলা হয় বঙ্গবন্ধুর দফতর থেকে চিঠি এসেছে। ২৫ মার্চে এই কপিটি পাওয়ার পর বাবা ভোরবেলায় হবিগঞ্জের নিমতলীতে মানুষের সামনে এই কপিটা দেখালেন এবং যার যা কিছু আছে তা নিয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান জানিয়ে বক্তব্য রাখলেন। ওখানে তখন মে. জে. এম এ রব সাহেব উপস্থিত ছিলেন। এরপর আমার বাবা বাহিনী গঠন করে যুদ্ধে চলে গেলেন। এসময় তারা বুঝতে পারলেন এখন আর তীর ধনুক দিয়ে হবে না। এখন মূল অস্ত্র লাগবে। এখন স্বাধীনতার ঘোষণা হয়ে গেছে। এরপর আমার বাবা অস্ত্র জোগাড় করে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। ৯ মাস যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন হয়। মায়ের কাছ থেকে শুনেছি, যুদ্ধের সময় বাবার চুল অনেক লম্বা হয়ে গিয়েছিলো। দাঁড়ি-গোফ বড় হয়ে গিয়েছিলো। ঘুম না হওয়ার কারণে বাবার চেহারা পরিবর্তন হয়ে গিয়েছিলো। মুক্তিযুদ্ধের পর বাবাকে কমান্ড্যান্ট উপাধি দেওয়া হয়েছিলো।
মানিক চৌধুরীর শেষ বক্তব্য উল্লেখ করে কেয়া চৌধুরী বলেন, ১৯৯০ সালে ১৬ ডিসেম্বর আমার বাবা তার জীবনের সর্বশেষ বক্তব্য দেন। সেখানে আমার বাবা বলছিলেন, একদিন কম্পন হবে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হবে। মুক্তিযোদ্ধাদের মূল্যায়ন হবে। এই বক্তব্যে তিনি যে কথাগুলো বলেছেন আমার মনে হয়েছে তিনি কথাগুলো আমাকে উদ্দেশ্য করেই বলছেন। তিনি বলেছেন সিলেটের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস অনন্য ইতিহাস। কারণ এখানে চা বাগান, প্রবাসী, হাওরের মানুষ, সমতলের মানুষ যেভাবে বঙ্গবন্ধুর প্রতিটি নির্দেশনাকে অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছেন অন্য জায়গা তা করেনি।
তিনি বলেছিলেন, আজকে হয়তো আমাদের সময় ভালো নয়, আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা তাদের সন্তানদের দুইবেলা খাওয়াতে পারে না। সকালে উঠে আমাদের কাঁধে লাঙ্গল নিয়ে এখনো মাঠে বের হতে হয়। মনে রেখো আমাদের সন্তানরা কিন্তু সেই সময়ে থাকবে না। আজকে যুদ্ধাপরাধীরা বড় বড় গাড়িতে চড়ে আমাদের হেয় করছে। একদিন আসবে যখন তারা মাথানত করে থাকবে। সে দিনে আমার বাবার বক্তব্য হুবহু মিলে গেছে। আমার বাবার স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য এবং এই কাগজটি রক্ষা করার জন্য ২০০৬ সাল থেকে একটি মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘর করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আপনারা জেনে খুশি হবেন। আমি আমার বাবা পৈতৃক সম্পত্তি যা পেয়েছি আমি সবগুলো দান করে দিয়েছি। যেখানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমার বাবাকে দেশবরণ্য ব্যক্তি হিসেবে আমার দানকৃত জায়গায় একটি জাদুঘর তৈরি করে দিচ্ছেন। যে জাদুঘরটির নাম হবে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর ও কমান্ড্যান্ট মানিক চৌধুরী স্মৃতি পাঠাগার।