‘সারারাত গোলাগুলি, ঘুম হলো না’
আশিক রহমান : একাত্তরের ২৫ মার্চ রাতে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের নবীন শিক্ষক, মহসিন হল-এর সহকারী আবাসিক শিক্ষক। মহসিন হল-এ আমার ছোট একটি বাসা ছিল। মহসিন হলে রাত সাড়ে দশটার একটু পরে খেতে বসেছি যখন তখন প্রথমে গোলাগুলির শব্দ পেলাম। গোলাগুলির শব্দটি ক্রমেই বাড়তে থাকল। খাওয়াটা কোনোরকমে শেষ করেছি। সারারাত গোলাগুলি, ঘুম হলো না। বিছানায় না শুয়ে মেঝেতে বিছানা করে শুতে হলো গোলাগুলির ভয়ে।
আমাদের অর্থনীতিকে ইতিহাসবিদ অধ্যাপক ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন বলেন, রাত আড়াইটার দিকে মহসিন হল-এর পাশ দিয়ে মাইকে কিছু প্রচার হলো, যা বুঝলাম সারাদিন সান্ধ্য আইন জারি থাকবে, ঘর থেকে বের না হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হলো। পরদিনও সারাদিন গোলাগুলি চলল। কোথায় হচ্ছে এই গোলাগুলি তখন বুঝিনি। পরে জেনেছি যে, ইপিআরের সদর দপ্তর পিলখানা ও রাজারবাগ পুলিশ লাইনে গোলাগুলি হয়েছে। দুপুরের দিকে নয়া বাজারের দিক থেকে আগুন ও ধোঁয়ার কুন্ডলী উড়তে দেখলাম। পরে শুনেছি নয়া বাজারের কাঠের আরত পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। এর মধ্যে দুপুর বেলায় আমার বাসার জানালা দিয়ে রেললাইনের দিকে তাকিয়েছিলাম, আজকের কাঁটাবনের রাস্তাটি ছিল রেললাইন, দুই দ্বারে বস্তি। আমি দেখলাম, একজন তরুণ, যার বয়স ২৪ বা ২৫ বছর হবে। তাকে সেনাবাহিনীর লোক ধাক্কা দিতে দিতে রেললাইনে ফেলে দিল। ছেলেটি হাত জোর করে কিছু বলছিল, ঠিক ওই মুহূতেই বেয়নট চার্জ করা হলো তার বুকের উপরে। দৃশ্যটি ছিল খুবই হৃদয়বিদারক। এমন দৃশ্য আমি জীবনেও দেখিনি। মাথাটা ঘুরে যাচ্ছিল, বসে পড়ি। এভাবে ২৬ তারিখ কাটল উদ্বেগ-উৎকন্ঠায়। ২৭ তারিখ সকালে ২ ঘন্টা সান্ধ্য আইন প্রত্যাহার করা হয়েছিল। আমি পথে বের হয়েছিলাম কিছু বাজার করে আনব। কিন্তু যখন মহসিন হল-এর মাঠের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিলাম তখন দেখলাম, কিছু মানুষ জটলা করে আছে। গিয়ে দেখি প্রায় ৬টি মৃতদেহ পড়ে আছে। রাতে গরিব মানুষেরা … বারান্দায় ঘুমাত, তাদের উপর গুলি করা হয়েছে। ওখানে শুনলাম ইকবাল হল-এর… এখানে ওখানে ছড়িয়ে আছে ছাত্রদের লাশ। শুনলাম, ড. মনিরুজ্জামানকে হত্যা করা হয়েছে। আর জগন্নাথ হল-এ অসংখ্য ছাত্রকে হত্যা করে মাটি চাপা দেওয়া হয়েছে। কারও হাত, কারও পা বের হয়ে আছে। এসব শোনা ও দেখার পর আর আমার বাজার করা হয়নি। আমি আমার মহসিন হল-এ ফিরে আসি।