নিউজ এবং খাবার স্যালাইন, বিশ্বাস ও বিভ্রান্তি
দেশের গণমাধ্যমগুলোর কিছু সংবাদের উদ্ধৃত সূত্র বিষয়ে লিখেছিলাম ক’দিন আগেই। ‘দৈনিক আমাদের অর্থনীতি’তে ‘সওয়ারি উদ্ভট উটের পিঠে’ শিরোনামে লেখাটি প্রকাশিত হয়েছিল। কিছু উদ্ভট টাইপ প্রতিষ্ঠান, সংস্থা ও ‘গ্রাউন্ডেড’ মাধ্যমকে সূত্র হিসাবে উল্লেখ করে সংবাদ প্রকাশের যে বিকৃত একটা প্রতিযোগিতায় নেমেছে দেশের কিছু গণমাধ্যম- তা নিয়েই মূলত লেখাটি। বলেছিলাম ‘নিউজ উইদ আউট ভিউজ’ সংবাদের ক্ষেত্রে এমন কথাটি বিস্মৃত প্রায়। ‘চেক-ক্রসচেকে’র ব্যাপারটিও উঠে যেতে বসেছে। অবস্থার ধারাবাহিকতায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ‘আপনি ভবিষ্যতে কী হতে চান, আপনার সাথে কোন সেলিব্রেটির মিল রয়েছে’ এমনসব ‘ফানি এপসে’র ফলাফলই ভবিষ্যতে সংবাদের সূত্র দাঁড়াবে- এমনটিই আশংকা করেছিলাম সে লেখায়। লেখাটি প্রকাশের এক সপ্তাহও যেতে দেয়া হয়নি, ইতোমধ্যেই দেশের প্রধান ক’টি সংবাদমাধ্যম ‘ফেসবুকে’র স্ট্যাটাস সূত্রে ‘মা’ বিষয়ে অত্যন্ত স্পর্শকাতর সংবাদ প্রকাশ করে ফেলে। সংবাদে একজন বৃদ্ধা মায়ের ছবি দিয়ে বলা হয়, ‘কোনও এক বিসিএস কর্মকর্তার মা তিনি। তার পুত্রবধুও বিসিএস দেয়া ম্যাজিস্ট্রেট। পুত্রবধুর কারণে সেই পুত্র মাকে রেলস্টেশনে ফেলে গেছেন এবং মার হাতে ধরিয়ে দিয়ে গেছে করুণ চিঠি।’ একজন ব্যারিস্টারের ফেসবুক স্ট্যাটাসকে সূত্র হিসাবে সম্বল করে এ বিষয়ে হৃদয়গ্রাহী সংবাদটি রচিত ও প্রকাশিত হয়। প্রকাশের পরপরই জানা যায়, উপজীব্য ঘটনাটি ভুয়া। বৃদ্ধার ছবিটিও দেশের নয় ভারতের। এই নিউজটি যে ‘ফেইক’ তাও খুঁজে বের করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমই। এখানেও গণমাধ্যম পিছিয়ে। এতটাই পিছিয়ে যে, নিজ কর্মীদের উপর ভরসা বাদ দিয়ে এখন দৌড়াতে হচ্ছে যোগাযোগ মাধ্যমের পেছনে। জানি না, পরবর্তীতে সংবাদটির ব্যাপারে উক্ত গণমাধ্যমগুলোর ব্যাখ্যা কী ছিল। ‘বিবিসি’ বা ‘রয়টার্সে’র মতন মাধ্যমগুলো এমন সংবাদ তুলে নিত এবং নেয়ার আগে অবশ্যই ব্যাখ্যা দিত, ক্ষমা চাইতো এবং সাথে যিনি এই সংবাদটি করেছেন তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নিত। এ বিষয়ে দু’দিন আগেই দেশের অন্যতম গণমাধ্যমের একজন বার্তা সম্পাদক দুঃখ করে জানাচ্ছিলেন, অযোগ্যদের নিয়োগ দানের কথা। বলছিলেন, ‘গণমাধ্যমে তো সরকারের কোটা প্রথার ব্যাপারটি নেই, তবে কেন এখানে অধিকতর যোগ্যরা জায়গা পাবে না।’ তাকে বলেছিলাম, আপনার পর্যবেক্ষণ ভুল। এদেশের সবখানেই কোটা আছে। বেসরকারি ক্ষেত্রে সে কোটা আরো ভয়াবহ। সরকারি ক্ষেত্রে তো লিখিত পরীক্ষা বলে একটা ব্যাপার আছে। সেখানে নূন্যতম যোগ্যতার একটা বিষয়ও আছে। কিন্তু বেসরকারি ক্ষেত্রে তো ‘কর্তার ইচ্ছাতেই কর্ম’। এখানে কোটা হলো, ‘তোষামোদ, স্বজন, আনুগত্য, কোন ক্ষেত্রে রাজনৈতিক পরিচয়’। দশ লাইনে চারটা বাক্যই ভুল, বার্তা সম্পাদনায় এমন ব্যক্তিও রয়েছেন। আর বানানের বিষয়টি তো এমনদের ‘ফেসবুক’ লেখনিতেই সহাস্যে দৃশ্যমান। ভুল সবারই হয়, প্রকৃতিই পরিপূর্ণতা পছন্দ করে না, এটা হুমায়ূন আহমেদের কথা এবং কথাটা সত্যি। কিন্তু ‘হঠাৎ ভুল’ আর ‘মাঝেমধ্যে শুদ্ধ’তার মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। আমাদের কিছু গণমাধ্যমের ক্রিয়াকর্মে সেই পার্থক্যটা এখন বিলুপ্ত প্রায়।
শুধু সূত্র বিষয়ক ভুলের বিভ্রান্তি নয়, কতক গণমাধ্যমের অনেক সংবাদের উদ্দেশ্য নিয়েও বিভ্রান্তির সৃষ্টি হচ্ছে। নিউজের সাথে ভিউজের মিশেলে সাংবাদিকতার আদর্শটাও যাচ্ছে ঘুটিয়ে। অনেকটা ‘খাবার স্যালাইনে’র মত। স্যালাইনের সাথে এসব নিউজের ‘ভয়াবহ’ রকমের মিল দৃশ্যমান। ‘এক মুঠো ভিউজ আর এক চিমটি নিউজ’, আর মিলটা এখানেই। ফুটনোট : যারা প্রায়শই ‘ফেসবুকে’ বিভিন্ন সংবাদ শেয়ার করেন, তাদের মধ্যে একটা উৎকন্ঠা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ‘ফেইক নিউজ’ শেয়ারে তারা সতর্কতা অবলম্বনের কথা বলছেন। তাদের সাথে আরেকটু যোগ করি, মিথ্যা খুব সহজেই চিহ্নিত করা যায়। সত্যের সাথে মিথ্যার মিশেল কিন্তু আরো ভয়াবহ, চিহ্নিত করাও কঠিন এবং যা সত্যটাকেও প্রশ্নবিদ্ধ করে। সুতরাং মিথ্যার চেয়ে অর্ধসত্য সংবাদ সম্পর্কে আরো বেশি সচেতন থাকা উচিত।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট/সম্পাদনা : মোহাম্মদ আবদুল অদুদ