আফগান-পাকিস্তান জটিলতার অবসান
সাউথ এশিয়ান মনিটর: পাকিস্তানের জন্য তার পশ্চিম দিকের প্রতিবেশীর সাথে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলা কম চ্যালেঞ্জের বিষয় নয়। এই প্রতিবেশীর সাথে পাকিস্তান বলতে গেলে কখনোই আন্তরিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। অবশ্য বিচ্ছিন্ন এই প্রতিবেশির সাথে সৌহার্দ্য প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে এখন বেশি। সবচেয়ে বড় কারণ হলো, যুক্তরাষ্ট্রের সাথে পাকিস্তানের সম্পর্ক এখন নির্ভর করছে পাকিস্তানের আফগাননীতির ওপর। আরেকটি বিষয় হলো, পাকিস্তানের প্রধান কৌশলগত মিত্র চীনও এখন আফগানিস্তান পর্যন্ত সিপিইসি সম্প্রসারণ করে একে বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) সাথে একীভূত করতে চায়। ফলে পারস্পরিক অনাস্থার নিরসন এবং জঙ্গি গ্রুপগুলোর সীমান্ত অতিক্রম করার মতো বিষয়গুলো পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের সমাধান করার ব্যাপারে পাকিস্তান-আফগানিস্তান উদ্যোগকে যুক্তরাষ্ট্র ও চীন উভয়ের সমর্থন প্রদান করা বিস্ময়কর কোনো বিষয় নয়।
আপাত দৃষ্টিতে মনে হতে পারে, বৈরী উপাদানগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের ব্যাপারে উভয় পক্ষই কিছুটা অগ্রগতি হাসিল করেছে। কিন্তু যে বিষয়টি অস্পষ্ট তা হলো, এসব গ্রুপ ঠিক কারা এবং তাদের বিরুদ্ধে উভয় পক্ষ ঠিক কোন ধরনের ব্যবস্থা নেবে?
তাছাড়া ‘সন্ত্রাসবাদের’ সংজ্ঞা ও কোন কোন উপাদান থাকলে কোনো জঙ্গি সংগঠনকে মেনে নেওয়া যায়- এমন কোনো সমঝোতাও দুই পক্ষের মধ্যে হয়নি। অবশ্য তারপরও দুই দেশের মধ্যে নিরাপত্তা ও সন্ত্রাসবিরোধী বিষয়াদি ছাড়াও পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট অর্থনৈতিক ও অন্যান্য ইস্যু নিয়ে কাজ করার জন্য আফগানিস্তান-পাকিস্তান অ্যাকশন প্লান ফর পিস অ্যান্ড সলিডারিটি (এপিএপিপিএস) গঠনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে।
সংলাপের প্রধান বিষয় নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা সহযোগিতা হলেও এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ওপরও আলোকপাত করা হয়েছে। অর্থাৎ আব্বাসি-গনি বৈঠকে মধ্য এশিয়ার সাথে পাকিস্তানের সংযোগ, জ্বালানি পরিবহন, কোয়েটা-কান্দাহার-হেরাত ও পেশোয়ার-জালালাবাদ রেলরোড ও পেশোয়ার-জালালাবাদ মহাসড়ক নির্মাণের মতো আঞ্চলিক কানেকটিভিটি বাড়ানোর বিষয়গুলো গুরুত্ব পেয়েছে। এসব প্রকল্প নিয়ে আলোচনার ফলে বৈঠকে উপস্থিত না থেকেও চীন যে কতটা তাৎপর্যময় ওঠেছে, তা বোঝা যাচ্ছে। দেশটি এ সংলাপ-প্রক্রিয়াতেও পরোক্ষভাবে প্রভাব বিস্তার করছে। ফলে পাকিস্তানের উন্নয়নবিষয়ক মন্ত্রী যখন বলেন, কোয়েটা কান্দাহার পর্যন্ত সংযোগ সড়কটি নির্মাণ নিয়ে ইতোমধ্যেই চীনের সাথে আলোচনা হয়েছে, তখন বিস্ময়ের কিছু থাকে না।
এ প্রকল্পটি সিপিইসির সাথে আফগানিস্তানের সংযোগের গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র ওঠতে পারে। আর এর মাধ্যমেই বৃহত্তর আঞ্চলিক অর্থনৈতিক নেটওয়ার্কে যুক্ত হতে পারে আফগানিস্তান।
এসবের মাধ্যমে ‘চীনা ফ্যাক্টরের’ কারণে আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতি বদলে যাওয়ার চিত্র প্রকাশ করছে। আবার এই পরিবর্তনই আফগানিস্তানের যুদ্ধ যে দ্রুত অবসান হওয়া উচিত, সে তাগিদও সৃষ্টি করেছে। সিপিইসিতে আফগানিস্তানের অন্তর্ভুক্তির জন্য যুদ্ধের অবসান জরুরি। কারণ যুদ্ধ আর উন্নয়ন একসাথে চলতে পারে না। তবে মনে রাখতে হবে, আফগানিস্তানে বিপুলভাবে চীনা উপস্থিতির বিরোধী যুক্তরাষ্ট্র। দেশটি চীনের সিপিইসিরও বিরোধী।
আফগানিস্তান যদি সিপিইসিতে যোগ দেয়, তবে কেবল যুদ্ধ বন্ধেই গুরুত্বপূর্ণ কিছু করবে তা নয়, সেইসাথে এর আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্যই নাটকীয়ভাবে বদলে দিতে পারবে।
দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়ার মধ্যে প্রধান সংযোগ হওয়ার মাধ্যমে বৃহত্তর ইউরেশিয়ান অঞ্চলের সাথে আফগানিস্তানের একীভূত হওয়াটা এমনিতেই যাবে। এতে করে কেবল তার সম্পর্ক নানা দেশের সাথেই হবে না, সেইসাথে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর মাত্রাতিরিক্ত নির্ভরশীলতাও হ্রাস পাবে।
তবে এগুলোর কোনো কিছু হতে হলে আফগানিস্তানের যুদ্ধ অবশ্যই অবসান ঘটতে হবে। আর আফগানিস্তান নিজে যদি তা না চায়, তবে যুদ্ধ বন্ধ হবে না। ঘানি নিজে যদিও তালেবানের সাথে নিঃশর্ত আলোচনার প্রস্তাব দিয়েছেন, কিন্তু আফগানিস্তানের অনেকেই তালেবানকে রাজনৈতিকভাবে মূলধারায় আনার সম্ভাবনার বিরোধিতা করছে।
আবার যুক্তরাষ্ট্রও তালেবানের সাথে সরাসরি আলোচনার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে। এর ফলে পর্যবেক্ষকদের মধ্যে প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র যদি যুদ্ধ বন্ধই করতে চায়, তবে কেন সে তালেবানের সাথে আলোচনা করতে চায় না?
আফগানিস্তানে সামরিক প্রাধান্য বজায় রাখার পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে অনেক কারণ আছে। তালেবানের সাথে তার যুদ্ধ অব্যাহত রাখার পেছনেও অনেক যুক্তি আছে। তবে উভয় ক্ষেত্রেই প্রধান কারণ সম্ভবত রাশিয়া-চীনের মদতপুষ্ট ইউরেশিয়ান একীভূত করার পরিকল্পনায় অব্যাহতভাবে প্রভাব বিস্তার করার জন্য তার এ অঞ্চলে উপস্থিত থাকা দরকার। আর চীন-রাশিয়ার ওই পরিকল্পনাটি সফল হলে তা হবে বৈশ্বিক পর্যায়ে পাশ্চাত্যের অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী।
ফলে আফগান যুদ্ধ সরে যাওয়ার কোনো ইচ্ছা যুক্তরাষ্ট্রের নেই। আর বিষয়টি সদ্য নিযুক্ত জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টাও বলেছেন।
অবশ্য আঞ্চলিক পরিবেশ সুস্পষ্টভাবেই যুদ্ধবিরোধী অবস্থান প্রকাশ করছে। সম্প্রতি তাসখন্দ সম্মেলনে মধ্য এশিয়ার দেশগুলো দ্ব্যর্থহীনভাবে আফগান শান্তি আলোচনার প্রতি তাদের সমর্থন দিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। তাদের এই সমর্থনের পেছনে আছে আইএস নামের উগ্রপন্থী সংগঠনের বিস্তৃত হওয়ার ভয়।
অন্যদিকে চীন ও রাশিয়া এই যুদ্ধবিরোধী মনোভাবকে পুঁজি করতে চাইছে। আফগানিস্তানের যুদ্ধ অনন্তকাল ধরে চলতে দেওয়ার মার্কিন পরিকল্পনার বিরোধিতা করার জন্য তারা এ মনোভাবকে ব্যবহার করার পরিকল্পনা করছে।
এক্ষেত্রে তারা কিছুটা সফলতাও পেয়েছে। পাক-আফগান ব্যাপকভিত্তিক সংলাপ এবং একে অপরের ভূখ- অন্য দেশে সন্ত্রাসী তৎপরতায় ব্যবহার হতে না দেওয়া নিয়ে উভয় দেশের সম্মতি এবং দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে গতিশীলতা সৃষ্টিতে তাদের সমঝোতায় বিষয়টি ফুঠে ওঠেছে।