‘সুকান্ত’রাই ইতিহাস হয়
কোটা সংস্কার আন্দোলন নিয়ে এখন পর্যন্ত ‘উইন উইন’ সিচুয়েশনে উভয়পক্ষ। অনেকটা সরকারি প্রেসনোটের ভাষায় ‘অবস্থা স্থিতিশীল’। প্রধানমন্ত্রী কোটা বাতিলের কথা বলেছেন, আন্দোলনকারীরা কথা কাজে পরিণত না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন স্থগিত ঘোষণা করেছেন। আন্দোলনের উত্তাপ কমে এখন চলছে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ। বিশেষ করে গণ ও সামাজিকমাধ্যমে ঘটনাক্রমের পূর্বাপর নিয়ে চলছে তুমুল লেখালেখি। তাই এ নিয়ে লেখার খুব বেশি আর কিছু নেই। তবে আন্দোলন চালানো ও ঠেকানো দুটোই কৌশলের বিষয়। এ আন্দোলনে এসব কৌশলের অধিকাংশ প্রয়োগই পরিলক্ষিত হয়েছে। এমন পর্যায়ে অর্জিত বিজয়কে বলা যায় ‘আপাত’। সফলতার প্রথম ধাপ, শেষ নয়। অর্জন আর রক্ষার মধ্যে পার্থক্যটা বিশাল। আর রক্ষাটাই হলো মূল সফলতা।
একটি আন্দোলনের সফলতা ও ভালোমন্দ নিয়ে কথা বলতে গেলে পূর্বাপর পর্যালোচনটা জরুরি। এতে অনেক কিছুই পরিষ্কার যায়। এ আন্দোলনের ঘটনাক্রমেও অনেক কিছু পরিষ্কার গেছে। মুখ ও মুখোশের পার্থক্যও অনেকটা পরিষ্কার। এটাও বড় অর্জন। এমন ‘অর্জন’ বিবেচনায় পরবর্তী ‘রক্ষা’র সিদ্ধান্তটাও নির্ভর করে মেধা-মননের উপর। যেহেতু ঘটনাক্রমের মূলেই ছিল মেধা-মেধাবী তথা যোগ্যতার প্রশ্ন। তবে এক্ষেত্রে বাধা দাঁড়াতে পারে বিষাদ ও অভিমান আক্রান্ত কিছু অবয়ব। এদের অনেকেই তাদের বিষাদিত ক্রোধ উগরে দিতে পারেন সামাজিক ও গণমাধ্যমে। দিচ্ছেনও। বিপরীতে জবাবও দিচ্ছেন অনেকে। কী প্রয়োজন এমন জবাবে, উপেক্ষার চেয়ে বড় জবাব আর কী আছে। বিষাদ হলো আবেগ, এর পরিণতি হলো ক্রোধে। আর আবেগ গতি পেলে বিবেক এমনিতেই রুদ্ধ হয়। ক্রোধের কোনও লজিক নেই। এ আন্দোলনের সবচেয়ে বড় দিক হলো, এটি পলিটিক্যাল মোটিভেটেড নয়, লজিক্যাল আন্দোলন। অনেকে অবশ্য এমন মুভমেন্টের ভেতরের কাহিনী সচিত্র রূপায়নে ব্যস্ত। তারা আবিষ্কার করতে চাচ্ছেন আন্দোলনের নানা রাজনৈতিক উপসর্গ ও উদ্দেশ্য। তা চাক, সব আন্দোলনেই এমন উপসর্গ-উদ্দেশ্য খোঁজা হয়, এটা দোষের কিছু নয়। এতে বরং আন্দোলন জাস্টিফাই হয়, শুদ্ধ হয়। অনেকে বলছেন, কোমলমতি ছেলেমেয়েদের ভুলিয়ে-ভালিয়ে আন্দোলনে নামানো হয়েছে। এটা যে তাদের অভিমানের কথা তা স্মৃতি হাতড়ালেই বোঝা যায়। তারাই প্রয়োজনে বর্ণনা করেছেন ছাত্র আন্দোলনের গৌরবগাঁথা। বলেছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা কখনো ভুল করে না। হয়তো এবারের আন্দোলনের সুরটা তাদের তালের সাথে যায়নি বলেই অভিমান। অভিমানীদের কথা থাক। আসি আন্দোলনকামীদের কথায়। প্রতিটি আন্দোলনের নেতৃত্বের স্তরে সুবিধাবাদী কিছু মানুষ থাকেন। ইতিহাসও তাই বলে। অনেক সময় আন্দোলনের সফলতা ধরে রাখা যায় না সে কারণেই। তবে আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী সাধারণেরা কিন্তু সুবিধাবাদের পরোয়া করেন না। যেমন করেননি এ আন্দোলনে। অনেকে জানেন, তারা বিসিএসে বসার যোগ্য নন। অনেকে জানেন, তাদের মেধা সেই মানের নয়, তবু তারা মিছিলে এসেছেন। এসেছেন মেধাবীদের, যোগ্যদের জায়গা করে দিতে। তারা এটুকু বোঝেন, যোগ্যরা যোগ্য জায়গা পেলে দেশের জন্য ভালো। আর দেশের ভালো মানে দশের ভালো, নিজেদের ভালো, পরবর্তী প্রজন্মের জন্য ভালো। তদের এই ভাবনা-বোধ আবেগ নয়, বিবেক নির্ভর। যারা এটাকে নেহাত চাকরি পাবার আন্দোলন বলে তাচ্ছিল্য করেন, তাদের বিষয়টি ভেবে দেখা দরকার।
দেশের জন্য, পরবর্তী প্রজন্মের জন্য এমন ভাবনা যে তারুণ্যের, চলুন তাদের ‘সুকান্ত’ বলি। ‘সুকান্ত’রাই আমিত্বকে পায়ে ঠেলে সকলের জন্য নির্দ্বিধায় বলতে পারে, ‘এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাবো আমি- নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।’ আর ‘সুকান্ত’রাই ইতিহাস হয়।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট/সম্পাদনা : মোহাম্মদ আবদুল অদুদ