কিছু কিছু অতীত স্মৃতি ভবিষ্যতের পথপ্রদর্শক
স্মৃতিতে মানুষ, নাকি মানুষের মধ্যে স্মৃতি? এ প্রশ্নের উত্তর জানার আগে জানতে চেষ্টা করতে হবে স্মৃতি কি? স্মৃতি বলতে অর্জন, অভিজ্ঞতা, ইতিহাস, বাস্তবতা নাকি অন্যকিছুকে বুঝায়! মাঝারি মানের উত্তর পেতে হলেও নিদেনপক্ষে একজন মনো-দার্শনিকের প্রয়োজন পড়বে বৈকি। স্মৃতির সংজ্ঞা না জানলেও এর প্রকারভেদ সম্পর্কে জ্ঞাতপ্রায় সর্বজন। সাধারণভাবে মানুষের জাগতিক সকল স্মৃতিগুলোকে সুখ স্মৃতি এবং দুঃখ স্মৃতি এই প্রকারভেদকে টেবিলভুক্ত করা যায়।
গর্ভধারণের সময় থেকে শুরু করে মৃত্যু পর্যন্ত মানুষের জীবনের প্রতিটি মুহুর্তেই কোন না কোন ঘটনার জন্ম নেয়। গর্ভধারণ প্রসব পূর্ব সময়কালে মা এবং সন্তান দু’জনের প্রতিটি মুহুর্ত মায়ের জীবনের স্মৃতির পটে একাকার রয়। কিন্তু জন্ম পরবর্তী ঘটনাগুলো সন্তানের যদিও স্বতন্ত্র তারপরও নিজস্ব মেমোরি স্টোরের অপরিপক্বতার জন্য পাঁচ ছয় বছর বয়স পর্যন্ত প্রতিটি মুহুর্তের ঘটনা তার বাবা-মা সহ আত্মীয় স্বজন ও প্রতিবেশীদের স্মৃতির পটে পরিগণিত হয়। তাই বলা যায়, স্মৃতিতে মানুষ বলতে পাঁচ ছয় বছর বয়স হতে মৃত্যু পর্যন্ত সময়কে, আর মানুষে স্মৃতি বলতে গর্ভধারণ হতে মৃত্যু পর্যন্ত সময়টুকুকেই বুঝায়।
সে যাই হউক। স্মৃতির সর্বজানা দু’রকম প্রকারভেদে হলো সুখ স্মৃতি, যা পরিমানে অনেক বেশী হলেও স্থায়িত্ব খুবই কম। প্রতিটি মানুষকেই তা মনে করার চেষ্টা করতে হয়। তবেই তা ক্ষণে ক্ষণে মিটিমিটি করে তাকায়। সমসাময়িক বিষয় সামনে এলেই কেবল চোখে ভাসে এবং হৃদয়ে স্পন্দিত হয়।
আর অন্যটি হলো দুঃখ স্মৃতি। যার ডাগর ডাগর চোখ দুটি বড় বড় করে তাকিয়ে থাকে একজন মানুষের ব্রেইন অবচেতন হওয়ার পূর্ব মুহুর্ত পর্যন্তও। কখনও কখনও ঘুমের মধ্যেও উঁকি মারে। মনে রাখতে চেষ্টা করতে হয় না।বরং ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করেও অনেক সময় পরাজিত হতে হয়। বিবাহের স্মৃতি নিঃসন্দেহে বড় বড় সুখ স্মৃতিগুলোর একটি, কিন্তু কে ক’দিনইবা তা মনে করে। কিন্তু ঐ স্বামী-স্ত্রীর দাম্পত্য বিচ্ছেদের স্মৃতি দু’জনকেই ধুকে ধুকে কাঁদায় জীবনের শেষ অবধি। দুঃখ স্মৃতিগুলো সারাজীবন ব্যাপি পীড়া দেয়। সাথে সাথে আরও দেয় জেদ, শক্তি, উদ্যম, প্রেরণা, ধৈর্য, আকাংখা, স্পৃহা, উত্তেজনা সর্বোপরি অর্জনের বাসনা। আর দুঃখ স্মৃতিগুলোকে পুঁজি করেই অনেক মানুষের জীবনে আসে সফলতা। এক্ষেত্রে অতৃপ্তি এবং দারিদ্রতার মতো দুঃখ স্মৃতিগুলোই অগ্রে ভূমিকা পালন করে থাকে।এ পৃথিবীতে যতজন সফলতার চরম শিখরে আসন গেড়েছে তাদের বেশির ভাগেরই অতৃপ্তি এবং দারিদ্রতা নামক দুঃখ স্মৃতিগুলোই প্রধান পুঁজি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ অনেক দেশের রাষ্টনায়ক, বিজ্ঞানী, সাহিত্যিক, দার্শনিক সহ নোবেল বিজয়ীদের বেশিরভাগ ব্যক্তিবর্গকে দ্রারিদ্রতাই করেছে মহান, মহৎ সর্বোপরি মহামনিষী। তাদের অনেকের ব্যক্তিগত জীবনী, লেখা কিংবা স্মৃতিচারণ থেকেই এর স্পষ্টতা লক্ষ্যনীয়। এর অহরহ উদাহরন বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দেশেও কম নয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান এর স্মৃতিচারতেই এটা প্রতিয়মান। চরম দারিদ্রতার মতো দুঃখ স্মৃতিগুলোই তাকে মর্যাদা ও সম্মানের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌছতে সিঁড়ি হিসেবে কাজ করেছে। বুয়েটসহ প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠের ন্যায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শহরের তুলনায় গ্রামের স্কুল কলেজ পড়ুয়া অর্থাৎ অপেক্ষাকৃত হতদরিদ্র এবং অগণিত দুঃখ স্মৃতিতে সমৃদ্ধ ছাত্র ছাত্রীদের ভর্তির হার লক্ষ্যনীয়। তেমনিভাবে পিএসসির প্রতিযোগীতা মূলক পরীক্ষা বা ক্যাডার সার্ভিসে স্বচ্ছল পরিবারের চেয়ে অস্বচ্ছল পরিবারের ছেলে-মেয়েদের প্রাধান্য চোখে পড়ার মতো। শহরের এবং সম্পদশালী পরিবারের ছেলে-মেয়েগুলোর জীবনের প্রাচুর্যতাই তাদের স্ব স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ক্ষত্রে অন্তরায়। কারণ, তাদের দুঃখ স্মৃতির পরিমান এত কম যে তাদের নেই কোন অতৃপ্তি, নেই কোন আকাঙ্খা। ব্যক্তিগত জীবন এবং পারিবারিকভাবে সম্পদশালী ও বিলাসপূর্ণ জীবন ধারার ফলে তাদেরকে কখনও কোন দুর্যোগ বা চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করার মতো পরিস্থিতিতে পড়তে হয় না। অন্যদিকে ক্ষণে ক্ষণে দুঃখ স্মৃতিতে আক্রান্ত ছেলে-মেয়েরা সহজেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় অভ্যস্থ।কারন তাদেরকে প্রায়ঃশই চ্যালেঞ্জের মুখোমুখী হতে হয় বৈকি! যার দরুন সে জানে, কিভাবে দুর্যোগময় মুহুর্তেও চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ব্যর্থ হলেও সফলতার রেকর্ডই বেশী। একটার পর একটা দুঃখ স্মৃতি তাড়া করে দরিদ্র কিংবা গ্রামের ছেলে মেয়েগুলো ক্রমেই উঠে সক্ষম। ফলশ্রুতিতে বৃদ্ধি পায় তাদের সক্ষমতা। অনেক শিক্ষকদের বেত্রাঘাত ও পিটুনি নামক ছোট ছোট দুঃখ স্মৃতিগুলোর বদৌলতে আজ কত জন যে উন্নতির স্বর্ণ শিখরে পৌছেছে তার কোন ইয়ত্তা নেই।
সুখ এবং দুঃখরা চাদর মুড়ি দিয়ে রেখেছে মানুষের জীবনকে। মানুষেরর জীবনই আবার জন্ম দেয় এই সুখ দুঃখ সমুহকে। আর এদের প্রভাবেই জন্ম নেয় স্মৃতিরা। এই স্মৃতিরাই আবার পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ করে সুখ এবং দুঃখকে। সুখ এবং দুঃখ স্মৃতির মাঝেই বিজড়িত মানুষের জীবন। সুখ স্মৃতিগুলো মানব দুঃখকে যেমনি সামান্যতম হলেও লাগব করে, তেমনিরূপে দুঃখ স্মৃতিগুলো মানব সুখকে করে স্থায়ী ও চির প্রতিষ্ঠিত।
পরিচিতি : সভাপতি, ঢাবি সমাজকল্যাণ এলামনাই ফোরাম/সম্পাদনা : মোহাম্মদ আবদুল অদুদ