‘আমাদের পুরো শিক্ষাব্যবস্থা এখন পরীক্ষা নির্ভর’
আশিক রহমান : বিভিন্ন খাতে বাংলাদেশের অনেক অর্জন রয়েছে। শিক্ষাখাতে অর্জন থাকলেও মান এখনো উল্লেখযোগ্যভাবে অর্জিত হয়নি। এ ছাড়া বিভিন্ন ক্ষেত্রে আমাদের যে অর্জনগুলো রয়েছে, সেসবের স্ট্যান্ডার্ড মান যদি অর্জিত না হয় সেগুলোও ঝুঁকির মধ্যে পড়বে। এটা আমাদের জন্য একটা উদ্বেগের বিষয়। তবে শিক্ষার মান একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া, রাজনৈতিক সদিচ্ছা, যথাযথ কৌশল ও বিনিয়োগ হলে মান একটা জায়গায় নিয়ে যাওয়া সম্ভব বলে মনে করেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও নারী আন্দোলনকর্মী রাশেদা কে. চৌধুরী।
আমাদের অর্থনীতিকে দেওয়া বিশেষ সাক্ষাৎকারে তিনি আরও বলেন, আমরা হয়তো লেখাপড়া শেখাচ্ছি তোতা পাখির মতো। শিক্ষার যে উদ্দেশ্য সেটা শিক্ষার মানের সঙ্গে সম্পৃক্ত। শ্রেণি কক্ষের ভেতরে পঠন-পাঠন কিভাবে পরিচালিত হয় তার উপর মান নির্ধারিত হয়। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে পড়ালেখার যে দক্ষতা পাচ্ছি তাকে আমরা কিভাবে মূল্যায়ন করব। শিক্ষক এখানে তার দক্ষতা, যোগ্যতা শিক্ষার্থীদের মধ্যে ট্রান্সফার করতে পারছেন কিনা নজর দিতে হবে সেখানে। অবকাঠামোগত বিষয় তো রয়েছেই।
এক প্রশ্নের জবাবে রাশেদা কে. চৌধুরী বলেন, আমাদের শ্রেণি কক্ষের পঠন-পাঠনে প্রচ- রকমের দুর্বলতা রয়েছে। আমরা পাঠ্যপুস্তুক দিয়েছি কিন্তু আমরা দেখতে পাচ্ছি শিক্ষার্থীরা অনেক বেশি গাইড পড়ছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া হওয়ার কথা
থাকলেও আমাদের শিক্ষার্থীরা এখন কোচিংমুখী। শিক্ষা ব্যবস্থায় এসব বড় ধরনের দুর্বলতা। দুর্বলতার প্রধান কারণ আমাদের পুরো শিক্ষা ব্যবস্থা এখন পরীক্ষা নির্ভর। উচ্চশিক্ষায় যাওয়ার জন্য দেশের একজন শিক্ষার্থীকে চারটি পাবলিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে হয়। এ পরীক্ষার বোঝা বইতে গিয়ে শিক্ষার্থীরা হিমশিম খাচ্ছে, অভিভাবকেরা ছুটছেন কোচিং সেন্টার ও গাইড বইয়ে আর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো অসুস্থ প্রতিযোগিতায় নেমেছে যে, কে কত বেশি জিপিএ পাচ্ছে তাদের শিক্ষার্থীরা।
তিনি বলেন, এত পাবলিক পরীক্ষা কেন থাকবে? তার মানে এই নয় যে, শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করা হবে না। তারা যা শিখছে তার তো মূল্যায়ন করতেই হবে। ধারাবাহিকভাবে শ্রেণিকক্ষে শ্রেণিভিত্তিক যে মূল্যায়ন তা শিক্ষকদের করতে হবে। সেটা নিয়মিত রিপোর্টিং করতে হবে। গোল্ডেন জিপিএ পেয়েও বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজ ভর্তি পরীক্ষায় শিক্ষার্থীরা হোচট খাচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, শিক্ষকেরা হচ্ছেন শ্রেণিকক্ষের চালিকাশক্তি। তাদের মধ্যে কিছুসংখ্যক অসাধু শিক্ষক থাকলেও বেশিরভাগ শিক্ষকই চেষ্টা করেন। কিন্তু তাদের দক্ষতা, যোগ্যতা ও প্রশিক্ষণে হয়তো ঘাটতি রয়েছে। বিশেষ করে মাধ্যমিক পর্যায়ে। কারণ মাধ্যমিকে শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়ায় স্কুল ম্যানেজিং কমিটির উপর নির্ভর করে। যেহেতু তারা বেসরকারি, সরকার এখানে নিয়ন্ত্রণ করে না, দিকনির্দেশনা থাকে সরকার বা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে। কিন্তু আমরা জানি বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই শিক্ষক নিয়োগে বাণিজ্য হয়ে থাকে। রাজনীতিকীকরণও হয়ে থাকে। অবকাঠামো শুধু উন্নয়ন নয়, রক্ষণাবেক্ষণ। নিয়মিত করতে হয়। সেখানেও প্রচ-রকম দুর্বলতা রয়েছে।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে রাশেদা কে. চৌধুরী বলেন, আমরা উন্নত বিশ্বের কাতারে যাওয়ার স্বপ্ন দেখছি, কিন্তু উন্নয়নশীল বিশ্বের ধারে কাছেও তো পৌঁছতে পারছি না। আমাদের জিডিপির মাত্র ২ শতাংশ ব্যয় করি শিক্ষায়, যেখানে শ্রীলঙ্কা ৭ শতাংশেরও বেশি ব্যয় করে। শিক্ষায় আমরা পর্যাপ্ত বিনিয়োগ করছি না। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় আমরা স্বাক্ষর করেছি, বাংলাদেশও প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, ন্যূনতম ৪ থেকে ৬ শতাংশ শিক্ষাখাতে ব্যয় করতে হবে। শিক্ষাখাতে যদি আমরা প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ না করি তাহলে হয় শিক্ষক ভালো হবেন না, অবকাঠামো ভালো না অথবা শ্রেণিকক্ষে পঠন-পাঠনও ভালো হবে না। কারণ আমার নুন আনতে পানতা ফুড়ায়। অর্থাৎ যেখানে যা প্রয়োজন যথাযথ বিনিয়োগ করা সেই অনুযায়ী বাজেটে বরাদ্দ রাখা অত্যন্ত জরুরি।