‘স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশ’প্রথম অধ্যায় পাঠের প্রতিক্রিয়া
(প্রথম পৃষ্ঠার পর) খুব একটা বিতর্ক হয় না। তবে উল্টোটা হলে? একজন নন-লীগার যদি মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কিছু লেখে? ডিপেন্ডস, তিনি কতটা আওয়ামী বন্দনা করেছেন। বন্দনার পরিমাণের ওপর নির্ভর করছে, বইটা বিতর্কিত হবে কি না।
এই যখন অবস্থা, অর্থাৎ, একজন নন-লীগারের জন্য মুক্তিযুদ্ধ যখন ভেরি মাচ আনটাচেবল একটা টপিক, তখন এই বিষয়ে কলম ধরা, আর ভীমরুলের চাকে ঢিল ছোঁড়া একই কথা। নো ডাউট, বইটা প্রকাশিত হলে, ভয়ানক রকমের রিয়াকশান হবে। বিতর্কের জন্ম তো দিবেই। পক্ষে এবং বিপক্ষে বেশ কিছু ফেসবুক স্ট্যাটাসও পড়বে। কে কে লিখবে এবং কী কী লিখবে, কে কে পড়ে লিখবেন আর কে বইয়ের নাম শুনেই ফতোয়া দিবেন, সেটাও এখনই বলে দেয়া যায়। যাই হোক, যথারীতি বেশ কিছুদিন ফেসবুক গরম করে তার অন্য দুটো বইয়ের মতো একসময় এই বইটিও হয়তো চার-পাঁচটি সংস্করণ সেরে ফেলবে, আই গেস। অ্যান্ড দেন? এরপরে বইটি ইতিহাসে জায়গা করে নেবে।
বই নিয়ে আলোচনায় যাওয়ার আগে একটু বলে নিই, এমনটা কেন হবে। বইটাকে কেন কেবল বই হিসেবে দেখা হবে না? তার কিছু কারণ আছে। আগেই বলেছি, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কিছু বলার বা লেখার সোল এজেন্সি আওয়ামীদের। অন্য কেউ, মানে নন-আওয়ামী কিন্তু অ্যান্টি-আওয়ামী না, এমন কেউ লিখলে, খতিয়ে দেখা হবে, বইটা সঠিক কি না, অর্থাৎ আওয়ামী বন্দনা ঠিকঠাক মতো হয়েছে কি না। বলাই বাহুল্য তা নির্ধারণ করবেন একজন আওয়ামী। এবং রিয়াকশান হবে মৃদু।
কিন্তু লেখক যদি প্রতিষ্ঠিত অ্যান্টি-আওয়ামী হন? কাহিনী এখানেই। পিনাকীদা যেহেতু নিজেকে অ্যান্টি-আওয়ামী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছেন, তাই, মুক্তিযুদ্ধ তার জন্য ভেরি ভেরি মাচ অনধিকার চর্চা। আর যেহেতু তিনি কাজটা করছেন, হি হ্যাজ টু ফেস দ্য কনসিকুয়েন্স।
প্রথম ধাক্কাটা আসবে ফেসবুকে। আগের বইগুলোতেও এমনটা হয়েছিল। কেউ কটাক্ষ করেছিল, পড়ে আর কেউ না পড়ে। ইউটিউবে ভিডিও-ও ছাড়া হয়েছিল। ওটা ছিল নি জার্ক রিয়াকশান। এই ভার্চুয়াল ওয়ার্ল্ডে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যেকোনো ন্যারেটিভ দেয়ার যে অলিখিত ফর্মুলা আছে, সেই ফর্মুলায় যে আঘাত এসেছিল, ওটা ছিল তার রিয়াকশান। যদিও বইটাতে আওয়ামী বিরোধিতা ছিল না, তারপরও আওয়ামী বাহিনী ব্যাপারটাকে ভালো চোখে দেখেনি।
কেন দেখেনি? নট সিওর। তবে আই গেস, আওয়ামী ফেসবুকারদের ধারণা, তারা ছাড়া অন্য কেউ মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লিখলে, তার পেছনে আসলে কেন উদ্দেশ্য থাকে। কেউ এসবের জন্য টাকা ঢালে। কেবল দেশপ্রেম থেকে লেখেন না। এমনটা করেন শুধু হার্ডকোর লীগাররাই। আর তাই তাদের জন্য ময়দান উন্মুক্ত। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তারা যা-ই লিখুন, নো প্রব্লেম। বিতর্ক হলে? অবধারিতভাবে লীগ বাহিনী পাশে থাকবে। ময়দানে আর আছেই বা কে? বিএনপি আর জামায়াত? এরা হয় হাবিজাবি টাইপ বিতর্ক করবে আর নয়তো চুপ থাকবে।
এই হচ্ছে নন আওয়ামী লেখকদের জন্য মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখার আফটার ইফেক্ট? আর আপনি যদি অ্যান্টি-আওয়ামী হন, তাহলে তো কথাই নেই। হামলা। কারণ উনারা নিশ্চিত, আপনি ইতিহাস বিকৃত করবেনই। আর তাই আপনার জন্য উপাধিও রেডি। ‘রাজাকার’ আর নয়তো ‘নব্য রাজাকার’। এখানে কিছুটা ছাড় আছে বামদের। ‘রাজাকার’ না দিয়ে লেবেল দেয়া হবে, ‘চিঙ্কু বাম’।
সো, হয় এসব দলের কোনো একটায় নাম লিখিয়ে ফেলুন আর নয়তো আপনার জন্য মুক্তিযুদ্ধ আনটাচেবল একটা টপিক। আইদার উইথ মি, অর এগেইন্সট মি। মাঝামাঝি থাকা যাবে না।
এই পক্ষ নেয়ার ঝামেলার সবচেয়ে বড় খেসারত দিচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ। তথ্য উপাত্ত ঘেঁটে লিখলেও আপনার নিস্তার নেই। বিশেষ করে সেই সময়ের ঘটনায় যদি আওয়ামীদের কোনো ভুল খুঁজে পান, তবে আপনার খবর আছে। ব্যাপারটাকে একতরফা বলব না। আপনার লেখায়, বর্তমানে বিএনপিতে আছেন, এমন কাউকে যদি কটাক্ষ করেছেন, তাহলেও আপনার বিপদ আছে। আপনি তখন আওয়ামী এজেন্ট।
এই কথাগুলো বলছি, কারণ, বইটা নিয়ে প্রতিক্রিয়া হবে এই ফর্মুলা মেনে। ফেসবুকে এই মুহুর্তে পিনাকীদা একজন অ্যান্টি আওয়ামী ব্যক্তিত্ব। আর অ্যান্টি আওয়ামী মানেই, তিনি অবধারিতভাবে, রাজাকার কিংবা পাকি প্রেতাত্মা। সো এমন এক ব্যক্তি যখন মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখে, তখন একটা ব্যাপার নিশ্চিত, তা হচ্ছে, উনার উদ্দেশ্য নিয়ে আশংকা প্রকাশ করা হবে। কিছু থিসিস হবে। প্রমাণ হবে, তার উদ্দেশ্য অসৎ এবং এর পেছনে আছে আইএসআই কিংবা সিআইএ। এবং একটি উপসংহার আসবে ‘ল্যাঞ্জা ইজ ডিফিকাল্ট টু হাইড।’
যাই হোক, এরপরও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখালেখি হয়েছে। আর যারা লিখেছেন, তারা এই ঝুঁকি নিয়েই লিখেছেন। আমার ধারণা তাদের সচেতনভাবে হোক আর অবচেতনেই হোক, বেশিরভাগে লেখকেরই মানসিকতায় এই ব্যাপারটা কাজ করেছে। নির্লিপ্ত, নিরপেক্ষ কেউই থাকতে পারেননি। দোষ কেবল উনাদের না, আমাদেরও। আমরা পাঠকরাও বোধহয় সঠিক তথ্য হজম করবার মানসিকতা রাখি না। বইগুলো পড়ে আমরাও তাদের ট্যাগ দিতে ছাড়িনি।
এবার আসি আসল টপিকে। হোয়াট অ্যাবাউট পিনাকীদা? উনি কি পারবেন নির্লিপ্ত থাকতে? বইটার প্রথম অধ্যায় যখন পিনাকীদা পাঠালেন, তখন প্রথম আমার মাথায় এই ব্যাপারটাই কাজ করেছিল। কতটা সঠিক ইতিহাস পাব। যেহেতু তার অবস্থান অ্যান্টি আওয়ামী, তাই প্রশ্ন জাগছিল, আওয়ামী কৃতিত্বগুলোকে কি তিনি ম্লান করবার চেষ্টা করবেন? মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আওয়ামীদের বীরগাথা বলতে কি কুণ্ঠিত বোধ করবেন? স্পেশালি আওয়ামীরা উঠতে বসতে তাকে যেভাবে ডিমোনাইজ করে, তারপরও কি তিনি আওয়ামী ন্যারেটিভের মাউথ পিস হবেন?
উল্টোটাও ভেবেছি। কোনো ব্যাপার আওয়ামীদের বিরুদ্ধে গেলে তিনি কি করবেন? বিতর্ক এড়াতে তিনি কি তা এড়াবেন? আওয়ামী রোষানলে পড়ার ভয় কতটা কাজ করবে?
ব্যক্তিগতভাবে আমি মানুষকে মানুষ ভাবতে পছন্দ করি। মানুষ মিনস, দোষে গুণে ভরা একজন মানুষ অ্যান্ড ননফেরেশতা একটি জীব। যে ভুল করে। রাগ, দুঃখ, লোভ, ঘৃণা এসবের বশে ঝোঁকের মাথায় সে অনেক কাজই করে। সো বিভিন্ন বই পড়তে গিয়ে যদি তিনি দেখেন, মুক্তিযুদ্ধের আমাদের নায়করা কোনো অন্যায় করেছিলেন, তখন তিনি কী করবেন। তাদের ফেরেশতা ইমেজ বজায় রাখতে সচেষ্ট হবেন? না মানুষ হিসেবে দেখাবেন?
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে খুব বেশি বই আমার পড়া নেই। সো বইটির প্রথম অধ্যায় পড়ে অনেক তথ্যই নতুন মনে হল। পড়তে খারাপ লাগল না। তারমানে এই না যে খুব ভালো লাগল। আসলে উনার বলার ভঙ্গিটা ভাল লাগেনি। না গল্প বলা হয়েছে, না ইতিহাস। মনে হয়েছে, উনি নিজেই দ্বিধাগ্রস্থ, ঠিক কোন টোনে লেখাটা লিখবেন। লেখাটা পড়ে আরও একটা ব্যাপার ফিল করলাম, তা হচ্ছে নিজের প্যাট্রিওটিজম প্রমাণ করবার অহেতুক চেষ্টা করছেন তিনি। আওয়ামী গালিগালাজের আফটার ইফেক্ট?
তাকে দোষ দিচ্ছি না। আসলে ফেসবুকের কল্যাণে, এই ব্যাপার তৈরি হয়েছে। আপনি আওয়ামী না হলে আপনার ভেতর দেশপ্রেম বলে কিছু নেই। আপনি রাজাকার, পাকি প্রেতাত্মা। পরের প্লেনেই পাকিস্তানে পাঠানো এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। আমি কিছুটা হতাশ, কারণ উনার কাছে এটা আশা করিনি। গত কয়েকবছর ধরে বিভিন্ন স্ট্যাটাসের মাধ্যমে তিনি তার অ্যান্টি আওয়ামী অবস্থান যে বেশ জোরেসোরেই জানান দিয়েছেন তা-ই না, উনার বিভিন্ন স্ট্যাটাস পড়ে মনে হয়েছে, এসব আওয়ামী ট্যাগিংয়ের তিনি কেয়ার করেন না। তাই ভেবেছিলাম, তিনি নির্লিপ্তভাবে লিখবেন। কিন্তু প্রথম অধ্যায়ে সেটা হয়নি।
মুক্তিযুদ্ধ অবশ্যই আমাদের একটি বীরগাথা, কিন্তু কথাটা বারবার বললে মনে হয়, আপনার মনে সন্দেহ আছে, তাই বেশি বেশি করে জানান দিচ্ছেন। প্রথম অধ্যায় পড়ে মনে হল, তিনি আওয়ামী ট্যাগিংকে কেয়ার করেন। সাবকনসাস মাইন্ডে হলেও আওয়ামী প্রোপাগান্ডা তাঁর ওপর ইফেক্ট ফেলেছে। তিনি যে প্রো মুক্তিযুদ্ধ, তা বোঝাবার অহেতুক চেষ্টা করেছেন। আর তা করতে গিয়ে লেখনীর সাবলীলতার বারোটা বাজিয়েছে।
‘পাছে আওয়ামীরা কিছু বলে’র যে ভয় তিনি পেয়েছেন, কিংবা বলা যায়, যে ট্যাগিং তিনি এড়াতে চেয়েছেন, তা তিনি পারবেন না। ট্যাগিং হবেই এবং ‘রাজাকার’ ট্যাগিং হবেই। কেউ বই পড়ে মন্তব্য করবেন, আর কেউ না পড়েই। ফেসবুকে বর্তমানে তিনি যে অবস্থান মেইন্টেইন করছেন, তার ভিত্তিতেই এই বইয়ের মুল্যায়ন করবে আওয়ামীরা। বই এরা যথারীতি খুলেও দেখবে না। এবং খেয়ে না খেয়ে এই বইয়ের গুষ্টি উদ্ধার করবেই। প্রশ্ন হচ্ছে, তথ্যগুলো কি তার অজানা? তা তো নয়। তাহলে কেন এই অতি সাবধানতা? এনিওয়ে, কেবল একটা অধ্যায় পড়ে সিদ্ধান্ত নেয়া অনুচিত। প্রথম অধ্যায় মোটামুটি হয়েছে। বাকি চ্যাপ্টারগুলোতে এই সমস্যাগুলো আছে কি না, বলতে পারছি না। তবে থেকে থাকলে, তা হবে ডিজাস্টার। আমার গাট ফিলিং হচ্ছে নিজের ইমেজ নিয়ে তিনি অতি সাবধানী হতে চেয়েছেন। কাজটা ঠিক করেছেন কি না, তা সময় বলে দেবে।
পরিশেষে আশা করব, বইটি নিয়ে আলোচনায় যেন একটা ব্যাপার হারিয়ে না যায়। আর তা হচ্ছে, বইটা আসলে কতটা বস্তুনিষ্ঠ হয়েছে। ইতিহাসের সাথে তিনি কতটা সততা দেখিয়েছেন। হোপ ফর দ্য বেস্ট।