জলবায়ু পরিবর্তনে বাড়ছে বজ্রপাত
দেশের তাপমাত্রা বেড়েছে দশমিক ৭৪ ডিগ্রী
‘বিশ্বে বজ্রপাতে সবচেয়ে বেশি মানুষের মৃত্যু হয় বাংলাদেশে’
আসাদুজ্জামান স¤্রাট: বিশ্বব্যাপি জলবায়ু পরিবর্তন বা গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের প্রভাবে বজ্রপাতের পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। গত তিন/চার বছরে দেশে বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা আশঙ্কাজনকহারে বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে সাম্প্রতিক সময়ে তাপমাত্রা দশমিক ৭৪ ডিগ্রী বৃদ্ধি পেয়েছে। যার প্রভাবে বজ্রপাতের সংখ্যাও বাড়ছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগ বলছে, গত রোববার সারাদেশে ১৮ ও গতকাল ১১ জনের মৃত্যু হয়েছে। চলতি সপ্তাহে এ সংখ্যা ৭১ ছাড়িয়েছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের রেকর্ড অনুযায়ী গত বছর সারাদেশে বজ্রপাতে ৩০১ জনের মৃত্যু হয়েছে। বাস্তবে এ সংখ্যা বেশি হতে পারে। ২০১৬ সালে ৩৫০ জন, ২০১৫ সালে ২৭৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় ২০১৬ সালের ১৭ মে বজ্রপাতকে দুর্যোগ হিসেবে ঘোষণা করে সরকার। বজ্রপাতের কারণ সম্পর্কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবহাওয়া বিজ্ঞান বিভাগের প্রধান অধ্যাপক তাওহিদা রশিদ বলছেন, বিজ্ঞানীরা অনেকে মনে করেন বিশ্বব্যাপী তাপমাত্রা বৃদ্ধির জন্য বজ্রপাত বেড়ে গেছে তবে অনেক বিজ্ঞানীই আবার এ মতের সাথে একমত নন। তবে বাংলাদেশে আমরাও ভাবছি জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেই তাপমাত্রা বেড়েছে এবং এর কিছুটা হলেও প্রভাব পড়েছে। বাংলাদেশে দশমিক ৭৪ ডিগ্রী তাপমাত্রা বেড়েছে।
বজ্রপাত বৃদ্ধির একক কোনো কারণ চিহ্নিত করা না গেলেও তাপমাত্রা বৃদ্ধি, বাতাসে সিসার পরিমাণ বেড়ে যাওয়া, জনজীবনে ধাতব পদার্থের ব্যবহারের আধিক্য, মোবাইল ফোন ব্যবহার ও এর টাওয়ারের সংখ্যা বৃদ্ধি, বনভূমি বা গ্রামাঞ্চলে উঁচু গাছের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে হ্রাস, জলাভূমি ভরাট ও নদী শুকিয়ে যাওয়া ইত্যাদি বজ্রপাত বৃদ্ধির অন্যতম কারণ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. একেএম সাইফুল ইসলাম বলেছেন, এসব কারণের প্রায় সবগুলোর সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তন ও উষ্ণায়নের সম্পর্ক আছে। তিনি বিশ্বখ্যাত সায়েন্স পত্রিকার এক নিবন্ধের উল্লেখ করে বলেন, ১ ডিগ্রি তাপমাত্রা বেড়ে গেলে বজ্রপাতের আশঙ্কা ১২ শতাংশ বেড়ে যায়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগবিজ্ঞান ও ব্যবস্থাপনা বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মাকসুদ কামাল বলেন, ইদানিং মেঘে মেঘে ঘর্ষণের ফলে বা ঘন কালো মেঘের ওপরের ও নিচের অংশ দুটি পুল হিসেবে প্রবাহিত হয়। এ কারণে বিদ্যুৎ প্রবাহিত হয়ে বজ্রপাতের সৃষ্টি হয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কালো মেঘের ঘনত্ব বেড়ে গেছে। হঠাৎ বৃষ্টিপাতের পরিমাণও বেড়েছে। তিনি বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে আবহাওয়ার ধরন পরিবর্তন এবং আকাশে কালো মেঘের পরিমাণ বেড়ে যাওয়া বজ্রপাত বৃদ্ধির কারণ।
বজ্রপাত ঠেকানো না গেলেও এর দ্বারা ক্ষয়ক্ষতি কমানো সম্ভব বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। ড. তাওহিদা রশিদের মতে বজ্র ঝড় যখন শুরু হয় এর তিনটি ধাপ আছে। প্রথম থাপে বিদ্যুৎ চমকানি বা বজ্রপাত শুরু হয়না। প্রথমে মেঘটা তৈরি হতে থাকে এবং সে সময় আকাশের অবস্থা খুব ঘন কালো হয় না। একটু কালো মেঘের মতো তৈরি হয়। সামান্য বৃষ্টি ও হালকা বিদ্যুৎ চমকায়। আর তখনি মানুষকে সচেতন হওয়া উচিত। বাইরে থাকলে যখন দেখা যাবে আকাশ কালো হয়ে আসছে তখনি নিরাপদ জায়গায় যেতে হবে। এ সময়টিতে অন্তত আধঘণ্টা সময় পাওয়া যায়।
ড. একেএম সাইফুল ইসলামের মতে, বিশ্বে বজ্রপাতে সবচেয়ে বেশি মানুষের মৃত্যু হয় বাংলাদেশে। পৃথিবীতে যত মানুষ মারা যান তার এক-চতুর্থাংশ মারা যান এ দেশে। সতর্কতামূলক পদক্ষেপ এবং প্রকৃতিকে ব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়েই এ দুর্যোগে মৃত্যু হার কমানো সম্ভব। যুক্তরাষ্ট্রও বিভিন্ন পদক্ষেপে বজ্রপাতে মৃত্যুর হার ৯০ শতাংশ হ্রাস করা হয়েছে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. জিয়াউর রহমান খান বলেন, মানুষ খোলা আকাশের নিচে যখন কাজ করে, তখন বজ্রপাতে বেশি আক্রান্ত হয়। এ জন্য একটু সতর্ক হলেই নিজেকে রক্ষা করা যাবে। আকাশে ঘন কালো মেঘ দেখলে দ্রুত নিরাপদ স্থানে চলে যেতে হবে। হাওর ও উন্মুক্ত এলাকায় বড় গাছ তো দূরের কথা, কোনো গাছপালাই থাকে না। উঁচু গাছের নিচে দাঁড়ানো যেতে পারে। কিন্তু বেশি সময় গাছের নিচে থাকা যাবে না। এ জন্য নিরাপদ ছাউনির নিচে আশ্রয় নিতে হবে। বজ্রপাতের আগে মানুষের মাথার চুল খাড়া হয়ে যায়। এটা একটা সতর্কবার্তা। তখনই দ্রুত সাবধান হতে হবে।