রাজীবরা চলে যায়, শুধু নির্লজ্জ থেকে যাই আমরা
মোহাম্মদ আবদুল্লাহ মজুমদার
রিমা দশম শ্রেণিতে অধ্যয়নরত। তার বাবা একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী। জনবহুল নগর ঢাকাতেই তাদের বসবাস। একদিন দুপুরে জোষ্ঠের অত্যন্ত খরতাপ। হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেছে তার বাবা। রাস্তায় বের হয়ে দেখে প্রচন্ড যানজট কিন্তু বাবাকে হাসপাতালে নেওয়ার মত কোন গাড়ী রাস্তায় নেই। সবগুলোই গুপরিবহন আর উচ্চবিত্তদের ব্যাক্তিগত গাড়ী। বাবাকে নিয়ে উত্তপ্ত রাস্তা হেটে পাড়ি দিয়েছে অনেকটুকু। এরপরই তাদের আটকে দিল পুলিশ। কারণ জানতে চাইলে বললো এখন প্রধানমন্ত্রীর গাড়ী বহর যাবে। যে যেখানে আছে সেখানেই দাড়িয়ে থাকতে হবে। রাস্তাভর্তি পুলিশ, কর্মচঞ্চল দুপুরে সাধারণ জনতাকে আটকে রেখেছে তারা।
রিমারাও আটক, অপেক্ষার যেন আর শেষ নেই। প্রতিটি সেকেন্ডে তার বাবা যেন এক ধাপ করে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। সবার প্রশ্ন প্রধানমন্ত্রী যাবে তো এত আগে থেকেই আমাদের আটকে রাখতে হবে? কিন্তু সে মূহুর্তে সাধারণ জনতার কথা তো মূল্যহীন। এক পার্যায়ে প্রধানমন্ত্রীর গাড়ী এলো। পুরো বহর শেষ হতে হতে প্রায় ১৫ মিনিট। গাড়ী বহর যাওয়া শেষ হতে হতে রিমার বাবার প্রাণও হয়ে গেল শেষ। এর পর যা হওয়ার তাই হলো। রিমার কিছুই করার থাকল না।
মাহি এক মধ্যবিত্ত পরিবাবের সন্তান। মা-বাবা গ্রামে থাকলেও সে শহরে থেকে বর্তমানে ¯œাতক শ্রেণিতে অধ্যয়ন করছে। কখনও প্রচুর্য আবার কখনও সংকট অতিবাহিত করে তার জীবন সমান্তরাল ভাবেই চলে। এক সন্ধ্যায় সারাদিনের কাজগুলো সেরে সে বাসায় ফিরছিল। এমন সময় হঠাৎ এক বিলাশবহুল গাড়ী এসে তাকে প্রচন্ড ভাবে ধাক্কা দিল। ডান হাত ও পায়ে দারুণভাবে আঘাত পেল সে। আঘাতের যন্ত্রণায় যে মূহুর্তে সে বাদ প্রতিবাদ কিছুই করতে পারছেনা ঠিক সে মূহুর্তে গাড়ীর ভেতর থেকে বিশাল দেহধারী এক মহিলা বেরিয়ে তার গালে কয়েকটি ছড় কষে দিল। বয়স ৪৫-৪৮ হবে।
বলল, অসভ্য ছেলে! জানিস আমার এ গাড়ীর দাম কত? যখন তখন কেন রাস্তায় এসে ঝামেলা করিস? ছোট লোক কোথাকার। মাহিকে এসব শুনিয়েই মহিলা চলে গেল। ততক্ষণেও তার ব্যথা নিয়ন্ত্রণে না আসায় সে কিছুই বলতে এবং করতে পারেনি। এভাবেই সহ¯্র বড়লোকদের যন্ত্রণা হয়ে ইট পাথরের শহরে করুণায় দিন যাপন করতে হয় বাড়ি-গাড়ী বিহীন ছোট লোকদের। ধন প্রাচুর্য শূন্য হওয়া যে কত বৃহৎ অপরাধ সেটি দালানের ও যানের শহরে না আসলে বোঝাই যায় না।
তেমনই অপরাধের শাস্তি পেল রাজীব। সহ¯্র যানের নগরে দুটি বাসের সংঘর্ষের মধ্যে দেহ হতে বিলিন হয়ে যায় রাজীবের ডান হাত। সঙ্গে সঙ্গে অজ্ঞান হতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে রাজীব। সে অজ্ঞান থেকে রাজীব আর ফিরেনি। চলে গেছে কোন এক অচেনা জগতে। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম বা যে কারণেই রাজীবের অপরাধের শাস্তির কথা গণমানুষ জেনে গেলেও প্রতিদিন অসংখ্য রাজীবকে হতে হয় যানবাহনের অপবলি। যে করুণ কাহিনী গুলো গণমানুষ না জানার কারণে নীরবেই হারিয়ে যায়। শুধুমাত্র রাজীবের মত গুটি কয়েক জনের জন্য আমরা অশ্রু ঝরাই। অনুদান, চাকরি আর সাহায্যের এজেন্সী দিয়ে বসি। কি নির্লজ্জ আমরা। তাই না? প্রত্যাহ এভাবে শুধু রাজীবরাই চলে যায়। কিন্তু অপরিবর্তীত রয় আমাদের নির্লজ্জতা।
লেখক: সাংবাদিক/সম্পাদনা : মো. এনামুল হক এনা