মিয়ানমার : শান্তিদূতের দানবে পরিণত হবার কাহিনী
কাকন রেজা
মিয়ানমারের সূচি এবং সাঙ্গপাঙ্গরা যখন মুসলিমদের উপর নিপীড়ণ চালালো, তখন অনেকেই ‘আরসা’ তথা রোহিঙ্গা বিচ্ছিন্নতাবাদীদের উপর দোষ চাপালেন। বললেন, ‘আরসা’ উগ্রপন্থী ওদের জন্যই রোহিঙ্গাদের উপর গড় হামলা হয়েছে। নিষ্ঠুর প্রক্রিয়ায় হত্যা, ধর্ষণ, লুটতরাজ, আগুন সবি এড়িয়ে বড় দাঁড়ালো ‘আরসা’র নামটি। আমাদের দেশের কিছু পন্ডিতজনও এমন সুরে ধোঁয়া ধরলেন। সবশেষ রোহিঙ্গাদের ঠাঁই হলো বাংলাদেশে। এ নিয়েও চললো উচ্চাভিলাষী রাজনীতি, কূটচাল। এসবের পরিণতি তো চোখের সামনেই। অতি সম্প্রতি মিয়ানমারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এসেছিলেন কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শনে। এ সময় ক্ষুব্ধ রোহিঙ্গারা বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছেন। সেই বিক্ষোভের খবর গণমাধ্যম এড়িয়ে গেছে দেশের স্বার্থ রক্ষার অজুহাতে। তাদের ধারণা ছিল দ্বিপাক্ষিক আলাপ আলোচনায় সব সমস্যার সমাধান যাবে। কিন্তু এখন গণমাধ্যমই বলছে, রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমার টালবাহানা করছে। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীকে কমনওয়েলথের সভায় আহ্বান জানাতে হচ্ছে মিয়ানমারকে চাপ প্রয়োগের। রোহিঙ্গাদের বিক্ষোভ এড়িয়ে গিয়ে হলোটা কী! জানি এর কোন উত্তর নেই। কর্ম যখন শুধু কর্তার ইচ্ছার উপর নির্ভর করে তখন কোন উত্তর থাকে না। আমাদের কোন কোন গণমাধ্যমের অবস্থাও তাই। মিয়ানমারের সাথে বৈরিতা এখন স্পষ্ট। সুতরাং এ ব্যাপারে সকল বিষয়ই আমাদের নজরে থাকা উচিত। মিয়ানমার যখন বললো রোহিঙ্গারা অনুপ্রবেশকারী, তারা বাংলাদেশের ভূখন্ডের মানুষ, তখনও আমরা তার সঠিক জবাব দিতে পারিনি। যখন বলা হলো মুসলিম টেরোরিস্টরা মানে ‘আরসা’ আশ্রয় পাচ্ছে বাংলাদেশে তখনও আমরা ছিলাম লা-জবাব। অথচ জবাব দেবার মতন তথ্য-উপাত্তের কমতি ছিল তা কিন্তু না। উপরন্তু মিয়ানমারেরই কোন শক্ত ‘লজিক’ ছিল না। সম্প্রতি মিয়ানমারের ঘটনা সম্পর্কে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোর দিকে তাকালে ‘কাচিন’ সম্প্রদায়ের উপর মিয়ানমারের ক্র্যাশ প্রোগ্রামের খবর চোখে না পড়ার কথা নয়। রোহিঙ্গাদের ক্ষেত্রে মুসলিম টেরোরিস্টদের তকমা এটে যারা মনে মনে নিজেকে ‘আনন্দ’ ভাবেন তারা কী এ ঘটনাপ্রবাহগুলো বিবেচনায় এনেছেন। প্রায় সব বিদেশি গণমাধ্যমই জানিয়েছে, বিচ্ছিন্নতাবাদীদের নিধনের অজুহাতে মিয়ানমারের সেনারা কাচিন সম্প্রদায়ের উপর নির্মম নিধনযজ্ঞ চালিয়েছে। খবর অনুযায়ী কদিন আগেই দু’হাজারের অধিক কাচিন পরিবার গভীর জঙ্গলে অবরুদ্ধ পড়েছিল। তাদের কাছে না ছিল খাদ্য, না পানীয়। এখানে জ্ঞাতব্য হচ্ছে, ‘কাচিন’রা কিন্তু মুসিলম নন, খ্রিস্টান। ক্ষমতার লালসা মানুষকে দানব করে তুলে। দানবদের বুভুক্ষতার কাছে কোন বাছবিচার নেই। কে মুসলিম, কে খ্রিস্টান, কে হিন্দু, কে ডেমোক্রেট, কে কম্যুনিস্ট কোন কিছুই বিবেচ্য নয় তাদের কাছে।
দুই.
অন্যায়কে জায়েয করার জন্য কিছু মানুষ সবসময়ই ছিলেন। গণহত্যার পেছনে হিটলারও যুক্তি দাঁড় করিয়েছিলেন। সে সময় হিটলারের সেই কথিত যুক্তিকেও কেউ কেউ বাহবা দিয়েছিলেন। কোন অন্যায়কে জায়েয করার জন্য এমন ‘যুক্তি’ মূলত অজুহাত। ব্যাংকের টাকা যারা লোপাট করেছেন তাদের অনেকেই মসজিদ-মাদরাসায় দান করেন। কেউ কেউ মসজিদ-মাদরাসাও গড়ে দিয়েছেন। এখন যদি বলা হয়, তিনি ব্যাংকের টাকা ঝেড়েছেন তাতে কী, তিনি তো ধান-ধ্যানও করেছেন। তিনি এ যুগের ‘রবিনহুড’। এই ‘রবিনহুড’ তত্ত্ব হলো অজুহাত। অন্যায়কে জায়েয করার নির্লজ্জতম প্রচেষ্টা। যারা করেন তারা লজ্জা-ঘেন্না-ভয় এই তিন জয় করেই করেন। কদিন আগে লেখায় ‘ক্যানিবলিজম’ নিয়ে কথা বলেছিলাম। প্রশ্ন রেখেছিলাম ‘ক্যানিবলিজম’ কী অন্যরূপে ফিরে আসছে। চারিপার্শ্বের অবস্থা দেখে মনে হচ্ছিল আমরা কী ক্রমেই ‘নরভূক’ সমাজ গঠন করতে চলেছি। অন্যায় যা প্রকাশ্যে দৃশ্যমান, ব্যক্তিগত মতাদর্শের কারণে তাকে অজুহাতের মোড়কে জায়েয করার চেষ্টা শুধু নির্লজ্জতা নয়, ক্রম ‘ক্যানিবাল’ উঠার লক্ষণ। ‘গ্লোবাল ভিলেজে’র চারিদিকে তাকালেই দেখতে পাবেন এমন হবু ‘ক্যানিবাল’দের। শুনতে পাবেন ‘ক্যানিবলিজমে’র পক্ষে ক্রমশ জোরালো উঠা সমন্বিত ফিসফিস। সময়ে সতর্ক না হলে এমন ‘ক্যানিবলিজমে’র বলি হতে পারেন যে কেউই।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট/সম্পাদনা : মোহাম্মদ আবদুল অদুদ