‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট’ উৎক্ষেপন, নতুন যুগে বাংলাদেশ
হুমায়ুন কবির খোকন ও উম্মুল ওয়ারা সুইটি : আজ যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায় স্থানীয় সময় বিকাল ৪টা ১০ মিনিটে (বাংলাদেশ সময় আজ দিবাগত রাত ২টা ১২ মিনিট থেকে ৪টা ২২ মিনিটের মধ্যে) উৎক্ষেপণ করা হবে বাংলাদেশের প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ ‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১’। আর এর মাধ্যমে নতুন যুগে প্রবেশ করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। এ অর্জন বাংলাদেশকে আরো একটি নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাবে। বিশেষ করে স্বাধীনতা অর্জনের পর যে বাংলাদেশকে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলেছিলেন তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার সেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকেই শুরু হচ্ছে মহাকাশ যাত্রা।
গাজীপুরের গ্রাউন্ড স্টেশনের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ফ্লোরিডায় উৎক্ষেপণ কার্যক্রমের সঙ্গে সরাসরি সংযুক্ত হবেন গণভবন থেকে। আর ফ্লোরিডার ক্যাপ ক্যানাভেরালে থাকবেন প্রধানমন্ত্রীর তথ্যপ্রযুক্তি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল। এর আগে গতকাল রাত ৮টায় স্পেসএক্স কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বৈঠক করেছে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি দল। বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি দলের পক্ষ থেকে এই বৈঠকে প্রধানমন্ত্রীর তথ্যপ্রযুক্তি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ের নেতৃত্বে আরও রয়েছেন, তথ্য প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম ও বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) চেয়ারম্যান ড. শাহজাহান মাহমুদসহ বাংলাদেশ সরকার ও বিটিআরসির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
জানা গেছে, বাংলাদেশ যখন তার স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী পালনের তিন বছর আগে মহাকাশ যাত্রার মাইলফলক অর্জন করতে যাচ্ছে ঠিক এর ৬১ বছর আগে মহাকাশে প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ উৎক্ষেপণ করে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন। ১৯৫৭ সালে উৎক্ষেপিত সেই কৃত্রিম উপগ্রহটির নাম ছিল স্পুটনিক-১। সংস্কৃতি মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নুর বলেছেন, আশ্চর্যজনক হলেও মহাকাশে ইতিহাস তৈরি করা সেই নামটির সাথেই আছে বাংলাদেশ। কেননা ‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১’ উৎক্ষেপণ এবং তা কক্ষপথে রাখার জন্য যে উপগ্রহ কোম্পানি সাথে চুক্তি হয়েছে; সেই কোম্পানির নামও স্পুটনিক। তাদের কাছ থেকেই প্রায় ২১৯ কোটি টাকায় ১৫ বছরের জন্য কক্ষপথ কেনা হয়েছে।
গত ৫ মে প্রতিষ্ঠানটির নিজস্ব টুইটার পেজে জানায়, উৎক্ষেপণের আগে সবচেয়ে বড় ধাপ পেরিয়েছে ‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১’। একে বহনকারী ফ্যালকন ৯ রকেটের ‘স্ট্যাটিক ফায়ার টেস্ট’ সফলভাবে সম্পন্ন হয়। এই প্রকল্পটি বাস্তবায়নে মোট খরচ হচ্ছে ২ হাজার ৯০২ কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকারি তহবিল থেকে দেয়া হচ্ছে ১ হাজার ৫৪৪ কোটি টাকা। আর ঋণ হিসেবে এইচএসবিসি ব্যাংক বাকি ১ হাজার ৩৫৮ কোটি টাকা দিচ্ছে।
১৯৭৫ সালের ১৪ জুন বেতবুনিয়ায় দেশের প্রথম ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্র উদ্বোধনের মাধ্যমে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের মহাকাশজয়ের সূচনা করেন জাতিরজনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তারপর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে থেমে যায় ।
এরপর ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে ক্ষমতায় এসে এ বিষয়ে অগ্রগতি শুরু করে। কিন্তু দীর্ঘ সময় ক্ষমতার বাইরে থাকার পর মাত্র ৫ বছর সময় এতো বড় কাজের জন্য যথেষ্ট ছিলো না। ফলে ২০০১ সালে সরকার পরিবর্তনের পর এ কাজ থেমে যায়। ২০০৯ এবং ২০১৪ পর পর দুই মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ অবশেষে বাংলাদেশের মহাকাশ যাত্রার স্বপ্ন বাস্তবায়নের কার্যকর উদ্যোগ নেয়ার সুযোগ পায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, ২০১৫ সালের ১১ নভেম্বর ফ্রান্সের থ্যালেস অ্যালেনিয়া স্পেসের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ নির্মাণের চুক্তি স্বাক্ষর করে বাংলাদেশ। চুক্তি অনুযায়ী, স্যাটেলাইটের কাঠামো, উৎক্ষেপণ-ব্যবস্থা, ভূমি ও মহাকাশের নিয়ন্ত্রণ-ব্যবস্থা, ভূ-স্তরে দুটি স্টেশন পরিচালনা সহায়তা ও ঋণের ব্যবস্থা করবে ফ্রান্সের নির্মাতা প্রতিষ্ঠানটি। ফ্রান্সের থুলুজে স্যাটেলাইটটির মূল কাঠামো তৈরির কথা দেয় থ্যালেস। ‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১’ কৃত্রিম উপগ্রহটি একটি জিও-স্টেশনারি স্যাটেলাইট বা ভূস্থির উপগ্রহ। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটে ২৬ কু-ব্যান্ড এবং ১৪ সি-ব্যান্ড মিলিয়ে মোট ৪০টি ট্রান্সপন্ডার থাকবে। এর মধ্যে ২০টি ট্রান্সপন্ডার বাংলাদেশের ব্যবহারের জন্য রাখা হবে। বাকি ২০টি ট্রান্সপন্ডার বিদেশি কোনো প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রির জন্য রাখা হবে। মহাকাশে স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের প্রক্রিয়া দেশের বাইরে সম্পন্ন হলেও গাজীপুরের জয়দেবপুর ও রাঙামাটির বেতবুনিয়ায় দুটি গ্রাউন্ড স্টেশন থেকে এটি নিয়ন্ত্রণ করা হবে।
মহাকাশে উৎক্ষেপণের পর বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ পরিচালনা, সফল ব্যবহার ও বাণিজ্যিক কার্যক্রমের জন্য ইতোমধ্যে সরকারি মালিকানাধীন ‘বাংলাদেশ কমিউনিকেশন স্যাটেলাইট কোম্পানি লিমিটেড’ নামে একটি কোম্পানি গঠন করা হয়েছে। নতুন এই কোম্পানিতে কারিগরী লোকবল নিয়োগ এবং তাদের প্রশিক্ষণও দেয়া হয়েছে।
উল্লেখ্য্য, ২০১৫ ‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১’ নির্মাণ চুক্তির পর কথা ছিলো ২০১৭ সালের ১৬ ডিসেম্বর সেটি মহাকাশে পৌঁছে যাবে। কিন্তু প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে সেবছরও উৎক্ষেপণের নির্ধারিত দিনও পার হয়ে যায়। এ বছরও উৎক্ষেপণের একাধিক তারিখ নির্ধারণ করার পরও আবহাওয়া জটিলতার কারণে তা সম্ভব হয়নি। সব শেষ ১০ মে নির্ধারণ করা হয়।