২৮৯ ভোট কেন্দ্রের মধ্যে ২৩৪টিই ঝুঁকিপূর্ণ খুলনায় নগর পিতা নির্বাচন আজ
হিরা তালুকদার ও খুলনা প্রতিনিধি শরীফা খাতুন শিউলী : শিল্পনগরী খুলনার নতুন নগর পিতা কে হবেন তা নির্ধারণ হবে আজ। ভোট নিয়ে অনেক শঙ্কা, উৎকণ্ঠা আর অনিশ্চয়তার মধ্যেই আজ মঙ্গলবার নির্বাচন হবে খুলনা সিটি কর্পোরেশনের। ৪ লাখ ৯৩ হাজার ৯২ জন ভোটার তাদের শহরের নতুন মেয়র নির্ধারণ করবেন। ভোট গ্রহণের জন্য প্রস্তুত ২৮৯টি কেন্দ্র। অথচ এর মধ্যে ২৩৪ কেন্দ্রই ঝুঁকিপূর্ণ। আর এ কারণকেই শঙ্কায় রয়েছেন এখানকার সাধারণ ভোটাররা। তাই দলীয় প্রতীকে প্রথম নির্বাচনে হবেন নগর পিতা তা নিয়ে আপাতত ভাবছেন না সাধারণ ভোটাররা। তাদের ভাবনা নির্বিঘেœ ভোট দেওয়া নিয়ে।
খুলনার এবারের সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মেয়র প্রার্থী জয়ের জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করেছেন। তবে ভোটের আগের দিন আওয়ামী লীগের প্রার্থী তালুকদার আব্দুল খালেক অভিযোগ করেছেন, বিএনপি প্রার্থী নজরুল ইসলাম মঞ্জু কালো টাকা ছড়াচ্ছেন। অন্যদিকে বিএনপি প্রার্থী মঞ্জু অভিযোগ করেছেন, সরকার সমর্থিত দলের প্রার্থী ভোট কারচুপির জন্য সব ধরণের প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছেন। তবে সাধারণ ভোটাররা বলছেন, খুলনার জন্য যিনি যোগ্য তাকেই ভোট দিয়ে নগর পিতা নির্বাচন করবেন। কিন্তু এতোগুলো ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্রে কেমন ভোট হবে তা নিয়ে শঙ্কায় আছেন সবাই।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এবারের নির্বাচনে দলীয় ভোটারের বাইরে নতুন ভোটাররা একটা ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়াবে। এছাড়া বরাবরের মতো বস্তিবাসীর ১ লাখ, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ৭০ হাজার, নতুন ৫২ হাজার ভোট নির্বাচনের ফলাফল নির্ধারণে ভূমিকা রাখবে। নির্বাচনে প্রভাব ফেলবে শ্রমিক শ্রেণির ৬০ হাজার, উর্দু ভাষাভাষীর (বিহারী) প্রায় ২০ হাজার এবং খুলনায় বসবাসরত একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক আঞ্চলিক ভোটার।
দলীয় মনোনয়নে প্রথমবারের এ নির্বাচনে মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ৫ জন। এরা হলেন আওয়ামী লীগ মনোনীত তালুকদার আবদুল খালেক, বিএনপি মনোনীত নজরুল ইসলাম মঞ্জু, জাতীয় পার্টির এসএম শফিকুর রহমান মুশফিক, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মাওলানা মুজ্জাম্মিল হক ও সিপিবি’র মিজানুর রহমান বাবু। এর মধ্যে মূল প্রতিদ্বন্দ্বী রয়েছেন বড় দু’দলের মনোনীত আওয়ামী লীগের তালুকদার আবদুল খালেক ও বিএনপির নজরুল ইসলাম মঞ্জু।
জানা গেছে, ২০১৩ সালের তুলনায় এবার নতুন ভোট বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ৫২ হাজার। এসব ভোট উভয়দলের মধ্যে ভাগাভাগি হয়ে যাবে বলে নগরবাসী মনে করছেন। বর্তমান প্রেক্ষাপটে তালুকদার আবদুল খালেককে সমর্থন দিয়েছেন ১৪ দল ও আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর জাতীয় পার্টি (জেপি)। আঞ্চলিকতার দিক দিয়ে খুলনায় অবস্থানকারী বরিশাল, বাগেরহাট, ঝালকাঠি, গোপালগঞ্জ, যশোর ও নড়াইলের বৃহত্তর অংশের সমর্থন পাবেন বলে আশা করছেন নৌকার সমর্থকরা। তবে আঞ্চলিকতার অপর অংশ মাদারীপুর ও সাতক্ষীরার একটি বড় অংশের সমর্থন রয়েছে মঞ্জুর প্রতি। এছাড়া তিনি বরিশাল, ঝালকাঠি, বাগেরহাটসহ অন্যান্য অঞ্চলের একাংশের সমর্থন পাবেন বলে বিএনপির নীতিনির্ধারকরা আশা করছেন।
সংখ্যালঘু ৮০ হাজার ভোটাররা খুলনা সিটির জয়-পরাজয়ে ভূমিকা রাখবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। বরাবরের মতো এবারও এই ভোট নৌকা মার্কায় যাবে বলে আশা আওয়ামী লীগের। তবে নগরীর ২৩ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর পদে বীরেন্দ্রনাথ ঘোষকে মনোনয়ন না দেয়ার কিছুটা অভিমান রয়েছে।
নগরীতে উর্দু ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর ভোট প্রায় ২০ হাজার। এ ভোটের একটি বড় অংশ বরাবরই বিএনপি পেয়ে আসছে। দু’দলের শীর্ষ নেতারাই বিহারী ক্যাম্পে তাদের ভোট পেতে দফায় দফায় বৈঠক করেছেন।
নগরীতে বস্তিবাসীর ভোট রয়েছে ১ লাখের মতো। এর আগের নির্বাচনগুলোতে এই ভোট অর্থের বিনিময়ে নিজের পক্ষে টানতে দেখা গেছে বিভিন্ন প্রার্থীকে। অনেকে মনে করছেন, সেই সময় আর নেই। এখন তাদের আয় রোজগার ভালো। তাদের ছেলেমেয়েরাও লেখাপড়া শিখছে। সেক্ষেত্রে তাদের মধ্যে সচেতনতা বেড়েছে। কারো দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ভোট দেয়ার সম্ভাবনা কমেছে। তাই বিশাল এই ভোট ব্যাংক সম্পর্কে কারোই স্পষ্ট ধারণা নেই।
এদিকে শ্রমিক শ্রেণির ভোটারের একটি বড় অংশ খালিশপুর-দৌলতপুর এলাকার পাটকল শ্রমিক। সম্প্রতি বকেয়া মজুরির দাবিতে তারা আন্দোলনে নেমেছিলো। তাদের ভোট নিয়ন্ত্রণের জন্য আওয়ামী লীগের নেতারা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিজিএমসি’র মাধ্যমে বকেয়া পরিশোধ করার ব্যবস্থা করেন। যে কারণে ক্ষমতাসীন লোকজনের দাবি, পাটকল শ্রমিকদের অধিকাংশ ভোট এবার নৌকায় যাবে।
খুলনায় হেফাজতে ইসলামের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে ১৫-২০টি মাদরাসা। ২০১৩ সালের সিটি নির্বাচনে এসব মাদরাসার শিক্ষক- কর্মচারীরা সরাসরি বিএনপির মেয়র প্রার্থীর পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন। এবারের নির্বাচনে তাদের তেমন কোনো কর্মকান্ড চোখে পড়েনি। তবে তাদের এক নেতা খুলনা ইমাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মাওলানা গোলাম কিবরিয়া ও খেলাফতে মজলিসের কেন্দ্রীয় নায়েবে আমীর মাওলানা সাখাওয়াত হোসেনকে নজরুল ইসলাম মঞ্জুর পক্ষে গণসংযোগে দেখা গেছে।
কেসিসি নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী তালুকদার আবদুল খালেকের প্রধান সমন্বয়কারী ও কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য এসএম কামাল হোসেন বলেন, খুলনার রূপসা থেকে ফুলবাড়ী পর্যন্ত সাধারণ মানুষের মধ্যে নৌকার পক্ষে গণজোয়ার সৃষ্টি হয়েছে। খুলনার মানুষ দলমত নির্বিশেষে উন্নয়নের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। সাধারণ মানুষের ভেতর একটি জাগরণ সৃষ্টি হয়েছে, যা ভোটের মাধ্যমে প্রতিফলন ঘটবে। লক্ষাধিক ভোটের ব্যবধানে তালুকদার খালেক মেয়র নির্বাচিত হবেন।
২০ দলীয় ঐক্যজোটের প্রধান সমন্বয়কারী জেলা বিএনপির সভাপতি অ্যাড. শফিকুল আলম মনা বলেন, গ্রেপ্তার-অত্যাচার-নির্যাতন করে মানুষের মন জয় করা যায় না। খুলনার মানুষ বারবার ধানের শীষের পক্ষে ভোট দিয়েছে। এবারও তার ব্যতিক্রম ঘটবে না। জনগণ ভোটকেন্দ্রে যেতে পারলে ও স্বাধীনভাবে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারলে ব্যালট বিপ্লবের মাধ্যমে বিপুল ভোটে নজরুল ইসলাম মঞ্জু বিজয়ী হবেন।
ভোটের প্রস্তুতি সম্পন্ন: আজ সকাল ৮টা থকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত বিরতিহীনভাবে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচন সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ করতে প্রস্তুত নির্বাচন কমিশন (ইসি)। গত রোববার থেকেই মাঠে নেমেছ বিজিবি। এ নির্বাচনে সাড়ে ৯ হাজার পুলিশ, বিজিবি, এপি ব্যাটালিয়ান, আনসার-ভিডিপি সদস্য দায়িত্ব পালন করছেন। পাশাপাশি থাকছে র্যাবের ৩২টি টহল টিম এবং ৪টি স্টাইকিং ফোর্স। একইসঙ্গে নির্বাচনের আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ও সিটি নির্বাচনের আচরণ বিধিমালা তদারকি করতে দায়িত্ব পালন করছে ৩১ জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট।
রিটার্নিং অফিসারের কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, খুলনা সিটি করপোরেশনে প্রথমবারের মতো মেয়র পদে দলীয় প্রতীকে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এবার মেয়র পদে ৫ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এছাড়া নগরীর ৩১টি সাধারণ ওয়ার্ডে ১৪৮ জন এবং ১০টি সংরক্ষিত ওয়ার্ডে ৩৯ জন কাউন্সিলর প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। ২৮৯টি কেন্দ্রের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ (ঝুঁকিপূর্ণ) কেন্দ্র রয়েছে ২৩৪টি এবং এবার ভোট কক্ষ রয়েছে ১ হাজার ৫৬১টি। আর অস্থায়ী ভোট কক্ষ ৫৫টি। প্রিজাইডিং অফিসার, সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার ও পোলিং অফিসার রয়েছেন ৪ হাজার ৯৭২ জন।
খুলনা জেলা প্রশাসক মো. আমিন- উল আহসান বলেন, খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ রয়েছে। নগরীতে ১৬ প্লাটুন বিজিবি মাঠে নেমেছে।
র্যাব-৬’র অধিনায়ক খোন্দকার রফিকুল ইসলাম জানান, নির্বাচন কমিশনের নির্দেশনা মোতাবেক নির্বাচনে র্যাবের ৩২টি টিম দায়িত্ব পালন করছে। খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের মুখপাত্র ও অতিরিক্ত উপ-কমিশনার সোনালী সেন বলেন, এ নির্বাচনে সাড়ে ৯ হাজার পুলিশ, বিজিবি, এপি ব্যাটালিয়ান ও আনসার সদস্যরা দায়িত্ব পালন করছে।