খেলাপি ঋণ সমস্যা : ‘জয়েন্ট রিভিউ’ কমিটি গঠনের সুপারিশ করছি
ড. আহমদ আল কবির
বর্তমানে যে বিপুল পরিমাণ খেলাপি ঋণ আছে ব্যাংকিং সেক্টরে তা রিভিউ করার জন্য একটি ‘জয়েন্ট রিভিউ’ কমিটি গঠন করা যেতে পারে। রিভিউ কমিটি গঠিত হবে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক, বাংলাদেশ ব্যাংক এবং সংশ্লিষ্ট গ্রাহকের প্রতিনিধি সমন্বয়ে এবং এই কমিটিকে তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তের ক্ষমতা দিতে হবে। এই তিনটি কর্তৃপক্ষ মিলে যদি রিভিউ করে তাহলে আমি মনে করি খেলাপি ঋণ সমস্যা অনেকটাই সমাধান করা সম্ভব। গ্রাহককে এখানে সব সময়ই বিশেষ বিবেচনায় নিতে হবে। তিনি কেন ঋণ পরিশোধ করতে পারছেন না তা জানতে হবে। এই উদ্যোগ নেওয়া হলে কিছু কিছু ক্ষেত্রে ভালো ফল পাওয়া যাবে। আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি, ক্লায়েন্ট বা ঋণ গ্রহিতাদের সঙ্গে আলোচনায় বসলে একটা সমাধানের পথ চলে আসে। সব ঋণ গ্রহিতাই যে খারাপ তা নয়। কেউ কেউ আছেন যারা নানা প্রতিকূল পরিস্থিতির কারণে ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে পারছেন না। তাদের বিষয়টি বিশেষভাবে বিবেচনার দাবি রাখে। প্রচলিত ব্যবস্থায় আদালত গড়িয়ে সমাধানে পৌঁছানো বেশ কঠিন এবং সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। এই আলোচনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্টতা খুবই প্রয়োজন। বাংলাদেশ ব্যাংক, সংশ্লিষ্ট ঋণদানকারী ব্যাংক এবং গ্রাহক মিলে আলোচনার মাধ্যমে যদি গ্রহণযোগ্য কোনো সমাধানে আসে তাহলে ভালো ফল পাওয়া যেতে পারে। এতে গ্রাহকদেরও আস্থা সৃষ্টি হবে ব্যাংকের প্রতি।
প্রত্যেক গ্রাহককে একটি লীড ব্যাংক ঘোষণা করতে হবে। তিনি যতগুলো ব্যাংকের সঙ্গেই লেনদেন করুন না কেন তাকে বলতে হবে যেকোনো একটি ব্যাংককেÑ এইটা আমার লিড ব্যাংক। বাংলাদেশে এক সময় এই ব্যবস্থাটি ছিল। গ্রাহক হয়তো ১০টি ব্যাংকের মাধ্যমে ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করেন। কিন্তু তাকে একটি ব্যাংককে লিড ব্যাংক ঘোষণা করতে হবে। এই লিড ব্যাংকে সংশ্লিষ্ট গ্রাহকের সকল তথ্য সংরক্ষিত থাকবে এবং নতুন ঋণ গ্রহণের পূর্বে লিড ব্যাংক সকল তথ্য দিবে। লিড ব্যাংক জানতে পারবে কোন ব্যাংকে সেই গ্রাহকের কি অবস্থা। এতে একজন গ্রাহক বা ঋণ গ্রহিতা মিথ্যে তথ্য বা ভুল তথ্য দিয়ে ঋণ গ্রহণ করতে পারবে না। অন্য ব্যাংককে প্রতারিত করতে পারবে না। একই দলিল দাখিল করে একাধিক ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ করতে পারবে না। অনেকেই হয়তো বলবেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের সিআইবি তথ্য থেকেও তো এসব পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের সিআইবি’তে সব তথ্য পাওয়া যায় না। সিআইবি অত্যন্ত পুরনো একটি পদ্ধতি।
বিশেষ আদালত গঠন করা। প্রচলিত আইনি ব্যবস্থায় দীর্ঘ সূত্রিতা লক্ষ্য করা যায়। গ্রাহক নানাভাবে ব্যাংকের আইনি ব্যবস্থাকে বিঘিœত করতে পারে। একজন উদ্যোক্তা ইচ্ছে করলে নানাভাবে মামলা দায়ের বা আপিল করে মামলার কার্যক্রম ২০/২৫ বছর আটকে রাখতে পারে। এই অবস্থা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়কে উদ্যোগ নিয়ে সংশ্লিষ্ট মহলের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে বিশেষ আদালত গঠনের ব্যবস্থা করতে হবে। খেলাপি ঋণ আদায় সংক্রান্ত যে সব আইন আছে তা সংস্কার এবং সংশোধন করতে হবে। ইংল্যান্ড-আমেরিকা বা অন্যান্য উন্নত বিশ্বে আপনি যদি বাড়ি বা সম্পদ ব্যাংকের নিকট বন্ধক দেন এবং পরবর্তীতে ঋণ খেলাপি হয়ে যান তাহলে ব্যাংক আপনার নিকট জিজ্ঞাসা না করেও সেই সম্পদ বিক্রি করে দেবে। এমন কি ঋণ গ্রহিতা যদি কোর্টেও যান তিনি এই সম্পত্তি বিক্রি ঠেকাতে পারবে না। কিন্তু আমাদের দেশে এটা করা সম্ভব হয় না। কারণ আমরা এ বিষয়ে বড়ই উদার। কিন্তু ঋণ খেলাপিদের বন্ধককৃত সম্পদ বিক্রির ব্যাপারে অতি উদারতার পরিচয় দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কাজেই এ বিষয়ক আইন পরিবর্তন/সংশোধন করা খুবই জরুরি। বন্ধকী সম্পত্তি বিক্রির ব্যবস্থা সংক্রান্ত আইনটি উন্নত দেশের আদলে পরিবর্তিত হওয়া উচিত। যদি এই পরিবর্তন সাধন করা হয় তাহলে খেলাপি ঋণ আদায়ের ক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নতি হবে। আমাদের দেশে দেখা যায়, অর্থঋণ আদালত বা নি¤œ আদালত কোনো একটি সিদ্ধান্ত প্রদান করার পর গ্রাহক উচ্চ আদালতে রিট করে বসে থাকল। এভাবে দিনের পর দিন চলতে থাকল। এই ব্যবস্থারও পরিবর্তন দরকার। কোন কোন ক্ষেত্রে চাইলেও রিট করা যাবে না তা নির্ধারণ করে দেওয়া দরকার।
লেখক : সাবেক চেয়ারম্যান, রুপালী ব্যাংক