টাঙ্গাইল তাঁতের শাড়ির সঙ্গে নতুন যোগ হয়েছে থ্রি পিস-ফোর পিস
অলক কুমার দাস, টাঙ্গাইল : ঈদুল ফিতরে পোশাকের প্রতি বাঙালির অনুরাগ চেতনাগত- অভিনব শাড়ির প্রতি সে টান মজ্জাগত। যেকোনও অনুষ্ঠানে বাঙালি রমণীর প্রথম পছন্দ শাড়ি। আসন্ন ঈদুল ফিতর উপলক্ষে তাই ঐতিহ্যবাহী টাঙ্গাইল শাড়িতেও এসেছে বৈচিত্র্যতা, অভিনবত্ব এবং বহুমুখী ব্যবহার। ঈদকে সামনে রেখে বেড়েছে তাঁতের শাড়ির বিকিকিনি। প্রাকৃতিক পরিবেশ অনুকূলে না থাকার কারণে এ বছর শাড়ি বিক্রিতে তেমন শোরগোল লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। ঐতিহ্যবাহী টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ি যুগ যুগ ধরে বাঙালি নারীর ফ্যাশনের প্রতীক হয়ে রয়েছে। এই শাড়িতেই যেন ফুটে ওঠে বাঙালি নারীর চিরায়ত বাস্তব রূপ। লাল পাড়ে তাঁত আর আড়াআড়ি ডোরা শাড়িতে ফুটে ওঠতো এক সময়কার বাঙালি নারীর কবি কল্পিত রূপ। ব্লক, বাটিক, প্রিন্টের শাড়ির ভিড়ে ৮০ দশকে হারাতে বসেছিল এই শাড়ির ঐতিহ্য। তবে এখন আবার ফিরে এসেছে টাঙ্গাইল শাড়ির ঐতিহ্য। এখন শহরের ফ্যাশনেবল নারীরাও পছন্দ করছেন তাঁতের সুতি শাড়ি।
তাঁত শাড়ির রাজধানী হিসেবে পরিচিত টাঙ্গাইলের পাথরাইলের তাঁতি এলাকা ঘুরে দেখা যায়, শেষ সময়ের ব্যস্ত সময় পার করছেন তাঁত শ্রমিকরা। আবহাওয়ার প্রতিকূল পরিবেশেও বিরামহীন দক্ষ হাতগুলো মাকু চালিয়ে বিভিন্ন ডিজাইনের শাড়ি তৈরি করছেন। এখানকার তাঁতিরা যুগ যুগ ধরেই তৈরি করছেন বেনারসি, সিল্ক, জামদানিসহ বিভিন্ন ধরনের শাড়ি। প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে শাড়ি কিনতে আসছেন ব্যবসায়ীরা। ইদানিং অবশ্য শাড়ির বহুমুখী ব্যবহার লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তাঁতিরাও তীক্ষè দৃষ্টি রেখেছেন সেদিকে। কয়েক বছর আগে টাঙ্গাইলের ঐতিহ্যবাহী শাড়ি কেটে মেয়েদের আধুনিক ডিজাইনের থ্রি-পিস/ ফোর-পিস তৈরি করা হতো। ধীরে ধীরে তাঁতের তৈরি কাপড়ের থ্রি-পিস/ ফোর-পিসও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। তাঁতিরাও নানা কাউন্টের সুতা, রঙ ও ডিজাইনে থ্রি-পিস/ ফোর-পিস তৈরিতে এগিয়ে আসেন। হাল ফ্যাশনের সুতী নান্দনিক থ্রি-পিসটিও তৈরি হচ্ছে টাঙ্গাইলে। টাঙ্গাইলের ঐতিহ্যবাহী শাড়ির সাথে অভিনবত্ব নিয়ে যোগ হয়েছে সুতী কাপড়ের থ্রি-পিস। ঢাকার বেইলি রোডের বধুয়া, যশোরের মনসা বন্ত্রালয়, খুলনার চায়না ফ্যাশন কুষ্টিয়ার রাজ মোহন, সিলেটের হারুন অর রশিদ এসেছেন পাথরাইলে তাদের প্রতিষ্ঠানের জন্য শাড়ি নিতে। তারা জানান, টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ির চাহিদা প্রচুর।
রোজার শুরুতে একবার এসে যে শাড়ি নিয়ে গিয়েছিলেন তা প্রায় সব শেষ হয়ে গেছে। মাঝে ফোনে চাহিদা জানিয়ে কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে শাড়ি নিয়েছেন। চাহিদা বেশি থাকায় আবারও নিজেরাই এসেছেন নতুন ধরনের শাড়ি নিতে। তারা জানান, তাঁতের শাড়ির সাথে এবার তারা সুতী হরেক ডিজাইনের থ্রি-পিসও নিচ্ছেন- বাজারে টাঙ্গাইলের সুতী থ্রি-পিসও একটি স্বতন্ত্র জায়গা করে নিয়েছে। তারা আরো জানান, টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ি অনলাইনে মার্কেটিং হওয়ায় ইদানিং প্রচারণাটা বেড়েছে। দেশি-বিদেশি ব্যবসায়ী-ভোক্তারা অনলাইনে দেখে-শুনে পছন্দের শাড়ির চাহিদা পাঠাচ্ছেন। মনে মণ্টুর শাড়ি, রঘুনাথ বসাকের শাড়ি সহ বেশক’টি শাড়ি ফ্যাক্টরি মালিক অনলাইনে শাড়ি কেনাবেচা করছেন।
টাঙ্গাইল শহরের বিশ্বাস বেতকার নীপা খান, সন্তোষের বিউটি আক্তার, বটতলার শারমিন আক্তারসহ অনেকেই এসেছেন নিজের এবং আত্মীয়-স্বজনদের জন্য শাড়ি কিনতে। তারা বলেন, উন্নতমানের সুতায় নিখুঁত বুননের জন্য এবং নতুন ডিজাইনের জন্যই টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ি তাদের বেশি পছন্দ। তাদের দাবি যেহেতু বাড়ির কাছেই তাঁত শাড়ির রাজধানী তাই ১০-১২টা আইটেম দেখে-বুঝে শাড়ি নিতে এসেছেন। অনলাইনে শাড়ির যে ছবি ও দাম দেওয়া থাকে তা অনেকটাই বাস্তবতার সাথে মিলেনা। এদিকে অনলাইন ব্যবসায়ীদের নজর দিতে হবে।
তাঁত শ্রমিক রমেশ চন্দ্র দাস ও আজমত আলী দীর্ঘ ১৪-১৫ বছর ধরে এই পেশায় জড়িত। তারা জানান, স্বাভাবিকভাবে সপ্তাহে ৩টা দোতারি জামদানি শাড়ি উৎপাদন করা যায়। কিন্তু ঈদের আগে শাড়ির চাহিদা বেশি থাকায় দিনরাত কাজ করতে হয়- এবার মহাজনরা সে রকম তাগিদ দিচ্ছেন না।
কালিহাতী উপজেলার রামপুর থেকে শাড়ি সরবরাহ করতে এসেছেন আবু বকর। তার তাঁত রয়েছে ১৮টি, অন্যের আরো ৮টিতে শ্রমিক দিয়ে শাড়ি বুনছেন তিনি। তিনি জানান, তারা মূলত শাড়ি তৈরি করে মহাজনের গদিতে দেন। মহাজনরাই বাজারজাত করে থাকেন। মহাজনরা শাড়ির ডিজাইন, নকশা ও সুতার প্রকার নির্ধারণ করে দেন। কখনো কখনো মহাজনের দেয়া পুঁজিতে শাড়ি তৈরি করে সরবরাহ করেন, শ্রমিক মজুরির সাথে বাড়তি কিছু টাকা পান। পরে বছর শেষে হিসাবান্তে মহাজনরা পুরো টাকা পরিশোধ করেন। তিনি আরো জানান, বছরের এ সময়টাতে শাড়ির চাহিদা বেশি থাকে। এজন্য তাদের প্রস্তুতিও রয়েছে।
টাঙ্গাইল শাড়ির রাজধানী পাথরাইলের অন্যতম তাঁত শাড়ি প্রস্তুতকারী নীলকমল বসাক বলেন, গত দুই-তিন বছরের তুলনায় এবার ঈদে টাঙ্গাইল শাড়ির বাজার অনেকটা মন্দা বলা যাবে না তবে আশানুরূপ নয়। আড়াই থেকে সাড়ে চার হাজার টাকা দামের শাড়িই বেশি বিক্রি হচ্ছে। সুতি শাড়িও বিক্রি হচ্ছে প্রচুর। ঈদকে কেন্দ্র করে প্রায় এক কোটি পিস টাঙ্গাইল শাড়ি বিক্রি হবে বলে আশা করেন তিনি। তিনি জানান, সুতী থ্রি-পিস ইদানিং তৈরি শুরু হয়েছে- তবে এখনও তেমন প্রসার পায়নি।